মার্গারেট নােবল ভগিনী নিবেদিতা হইয়া ভারতের ইতিহাসে কি বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন, তার বহু অজ্ঞাত তথ্য আজও উদ্ঘাটিত হয় নাই—ইহা ভারতীয় ঐতিহাসিকদের পক্ষে গৌরবের বিষয় নহে। সম্প্রতি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত শঙ্করী প্রসাদ বসুর ‘নিবেদিতা লােকমাতা’ নামক মহামূল্য গ্রন্থখানি পড়িয়া মনে হইতেছে, এতদিনে সে-অভাব দূর হইল।—লিখেছিলেন বিবেকানন্দ মুখােপাধ্যায়, তাঁর এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় রচনায়। বস্তুত, ‘নিবেদিতা লােকমাতা’ যে নিবেদিতার জীবন ও সাধনা সম্পর্কে ‘শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, এমন রায় দিতেও ইতস্তত করেননি সমকালীন সমালােচক। কালজয়ী এই সৃষ্টিকে নিবেদিতা জীবনের ‘মহাভারত’ রূপেও আখ্যাত করেছিলেন একটি বিশিষ্ট সাহিত্যপত্রিকা। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সেই অসামান্য গ্রন্থেরই দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হল। খণ্ড পরিচয় নয়, ভগিনী নিবেদিতার সামগ্রিক পরিচয়টিকেই এই মহাগ্রন্থের খণ্ডে-খণ্ডে তুলে ধরেছেন শঙ্করীপ্রসাদ। গবেষকের তথ্যনিষ্ঠা, ঐতিহাসিকের সত্যদৃষ্টি ও সাহিত্যিকের মনীষার এক অনন্য ত্রিবেণীসঙ্গম শঙ্করীপ্রসাদের এই অক্লান্ত সাধনাসিদ্ধ রচনায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু—ভারতের জাতীয় আন্দোলনে নিবেদিতার ভূমিকা সন্ধান। নিবেদিতার বিপুল সংখ্যক অপ্রকাশিত পত্র, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনা, বিভিন্ন স্মৃতিকথা, সমকালীন পত্র-পত্রিকার সাক্ষ্যবলা যায় একেবারে মন্থন করে শঙ্করীপ্রসাদ তুলে এনেছেন এতকাল-অজ্ঞাত এক নতুন ও চমকপ্রদ মূর্তিকে, রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডেই যাঁর কর্ম সমাপ্ত নয়, যিনি সামগ্রিক জাতীয় জাগরণ সৃষ্টিতে অগ্রণী নেত্রী—যার অন্তর্গত সত্যকার রেনেশাঁস। লেখকের দাবি—নিবেদিতা এদেশে জাতীয়তা দর্শনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা এবং ওকাকুরার সহযােগিতায় প্রথম সক্রিয় বৈপ্লবিক কার্যকলাপ শুরু করেন। বিবেকানন্দের ভাব ও চিন্তাকে জাতীয়তার খাতে প্রধানত নিবেদিতাই করেছেন প্রবাহিত। এ বইয়ের পাতায় পাতায় বিস্ময়। বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ক্রান্তিযুগের (১৯০২-১৯১১) কাহিনী জানতে এ-গ্রন্থ অপরিহার্য। ৬৬টি দুষ্প্রাপ্য ফ্যাকসিমিলি ও ছবি এ-যুগের ইতিহাসকে চাক্ষুষ করে তুলেছে।
শঙ্করীপ্রসাদ বসু - বিশ শতকের বঙ্গসংস্কৃতির এই অগ্রণী ব্যক্তিত্বের জন্ম ২১ অক্টোবর ১৯২৮ হাওড়া শহরে। শিক্ষা হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন, রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ), প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। আবাল্য রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৫০-এ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম।শ্রেণিতে প্রথম। শিক্ষকতা হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন, হাওড়া দীনবন্ধু কলেজ, হাওড়া গালর্স কলেজ, আমহাস্ট স্ট্রিট সিটি কলেজ, বঙ্গবাসী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৩এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ি অধ্যাপকপদ থেকে অবসর গ্রহণের পর, আমৃত্যু রামকৃষ্ণ ইনস্টিটিউট অব কালচারের (গোলপার্ক) স্বামী বিবেকানন্দ আর্কাইভসের ডিরেক্টর এবং নিবেদিতা-চেয়ারে অধিষ্ঠিত। বাংলআ এবং ইংরাজীতে পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রন্থের রগয়িতা এবং সম্পাদক। দেশী-বিদেশী পুরস্কারে সম্মানিত – সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বিবেকানন্দ পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, শরৎ পুরস্কার (ভাগলপুর),জগত্তারিণী মেডেল, সরোজিনী বসু মেডেল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লেকচারশিপ পুরস্কার (এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা), নিউইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটি শতবার্ষিকী পুরস্কার ইত্যাদি। রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সাম্মানিক ডিলিট। নিউইয়র্ক এবং লসএঞ্জেলেস বঙ্গসম্মেলনে দুবার নিমন্ত্রিত অতিথি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি। দীর্ঘ অসুস্থতার পরে ৬ জুলাই ২০১৪এ রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে ছিয়াশি বছর বয়সে প্রয়াণ।