গবেষকের তথ্যনিষ্ঠা, ঐতিহাসিকের সত্যদৃষ্টি ও সাহিত্যিকের মনীষার এক দুর্লভ ত্রিবেণীসঙ্গম শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘নিবেদিতা লােকমাতা’ নামের এই অক্লান্ত সাধনাসিদ্ধ মহাগ্রন্থে। আংশিক আভাস নয়, ভগিনী নিবেদিতার সামগ্রিক এক পরিচয়ই এ-গ্রন্থের খণ্ডে-খণ্ডে। সেই অসামান্য গ্রন্থেরই চতুর্থ খণ্ড প্রকাশিত হল। নিবেদিতা ও সমকালীন ভারতের শিল্প-আন্দোলন সম্পর্কে সরস, সুবিস্তৃত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ আলােচনা এই খণ্ডে। এর মধ্য দিয়ে এক দিকে নিবেদিতার কার্যত-অনালােচিত এক বিপুল কর্মকীর্তির উদঘাটন। অন্য দিকে, আধুনিক ভারতীয় শিল্প আন্দোলনের—‘নিউ বেঙ্গল স্কুল’, ‘বেঙ্গল স্কুল’ ইত্যাদি নামে যা কিনা অধুনা আখ্যাত—বিকাশ ও অগ্রগতির সঙ্গে নিবেদিতার ঘনিষ্ঠ ও ব্যাপক যােগ দেখানাের সূত্রে এই আলােচনা হয়ে উঠেছে ওই আন্দোলনেরই সূচনাপর্বের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক ইতিহাস। সেই ইতিহাস শুধুই তথ্যে-তত্ত্বে সজীব ও অনুপুঙ্খময় নয়, ভিন্নতর এবং যুক্তিসিদ্ধ এক দৃষ্টিকোণ থেকেও উপস্থাপিত। শিল্প-জাগরণের এই ইতিহাস বাংলার গৌরবযুগের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠককে। জানিয়ে দেয়, ভারতীয় জীবনের ব্যাপক বিকাশে তৎপর নিবেদিতা জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে শিল্প-জাগরণের ভূমিকাকে কোন্ বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতেন। জানিয়ে দেয়, কীভাবে তাঁর শিল্পালােচনা প্রায়শই হয়ে উঠত উচ্চাঙ্গের সৃজনশীল সাহিত্য, কী বিরল ছিল তাঁর রসানুভূতি, পাশ্চাত্য ক্লাসিক শিল্পের ভক্ত হয়েও পরবর্তী শিল্প সম্পর্কেও তাঁর আগ্রহ ছিল কতটা অটুট, ভারতীয় শিল্প আন্দোলন সম্পর্কে প্রশংসাপর হয়েও বারেবারে কীভাবে তিনি জোর দিয়েছিলেন জনজীবনকে শিল্প ও ভাস্কর্যের বিষয় করে তােলার প্রয়ােজনীয়তার উপর, ‘গ্রীক প্রভাবে ভারতীয় শিল্পের উৎপত্তি’—এই তত্ত্বকে কীভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তিনি। এই আলােচনায় সমকালীন বাংলার ও ভারতীয় শিল্পী ও শিল্পরসিকদের কথা যেমন এসেছে, তেমনই এসেছে পাশ্চাত্য শিল্পী-ভাস্কর ও শিল্পতাত্ত্বিকদের প্রসঙ্গও। উদ্ঘাটিত হয়েছে সেকাল-একালের বহু বিতর্কের সঠিক প্রেক্ষাপট। এছাড়াও, এ-গ্রন্থে সংযযাজিত হয়েছে একশাে তিরিশটিরও বেশি দুষ্প্রাপ্য রঙিন ও সাদাকালাে ছবি যা এই ইতিহাসকে চাক্ষুষ করে তুলেছে।
শঙ্করীপ্রসাদ বসু - বিশ শতকের বঙ্গসংস্কৃতির এই অগ্রণী ব্যক্তিত্বের জন্ম ২১ অক্টোবর ১৯২৮ হাওড়া শহরে। শিক্ষা হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন, রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ), প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। আবাল্য রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৫০-এ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম।শ্রেণিতে প্রথম। শিক্ষকতা হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন, হাওড়া দীনবন্ধু কলেজ, হাওড়া গালর্স কলেজ, আমহাস্ট স্ট্রিট সিটি কলেজ, বঙ্গবাসী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৩এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ি অধ্যাপকপদ থেকে অবসর গ্রহণের পর, আমৃত্যু রামকৃষ্ণ ইনস্টিটিউট অব কালচারের (গোলপার্ক) স্বামী বিবেকানন্দ আর্কাইভসের ডিরেক্টর এবং নিবেদিতা-চেয়ারে অধিষ্ঠিত। বাংলআ এবং ইংরাজীতে পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রন্থের রগয়িতা এবং সম্পাদক। দেশী-বিদেশী পুরস্কারে সম্মানিত – সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বিবেকানন্দ পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, শরৎ পুরস্কার (ভাগলপুর),জগত্তারিণী মেডেল, সরোজিনী বসু মেডেল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লেকচারশিপ পুরস্কার (এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা), নিউইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটি শতবার্ষিকী পুরস্কার ইত্যাদি। রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সাম্মানিক ডিলিট। নিউইয়র্ক এবং লসএঞ্জেলেস বঙ্গসম্মেলনে দুবার নিমন্ত্রিত অতিথি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি। দীর্ঘ অসুস্থতার পরে ৬ জুলাই ২০১৪এ রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানে ছিয়াশি বছর বয়সে প্রয়াণ।