১৩৪৯ সালে “রবীন্দ্রসঙ্গীত” নামে যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলাম, তাকে বলা চলে পূজনীয় গরু দেব রবীন্দ্রনাথের গান, নৃত্য ও অভিনয় জীবনের ভূমিকা। আগ্রহী পাঠকগণ সেই কারণেই তৃপ্ত না হয়ে বারে বারেই আমাকে অনুরোধ করতেন আরো বিস্তারিত ভাবে গরু দেবের এ-জীবনের কথা শোনাতে। শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতার জীবনের প্রবল চাপে সে অনুরোধ রক্ষা করবার অবসর আমি পাইনি। তব,ও, কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদকের আগ্রহে এবং উৎসাহে লেখার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল না, অসবিধার মধ্যেই মাঝে মাঝে লিখতে বাধ্য হয়েছি। সেগুলিকেই এবারকার “রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা” গ্রন্থে সাজিয়ে প্রকাশ করা হলো। পূজনীয় গরদেবের বিচিত্রপথগামী জীবনের প্রকাশে সঙ্গীত, নৃত্য ও নাটকের ছিল একটি সম্মানজনক স্থান। এপথে, ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর যেমন ছিল গভীর অনুরাগ তেমনি অনুরাগ ছিল তাঁর ইয়োরোপীয় সঙ্গীত-সংস্কৃতির প্রতি। তাকেও তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর সৃষ্টির কাজে। কিন্তু প্রকাশ কালে দেখা গেল তার একটি সমন্বয়ধর্মী ভারতীয় রূপ । পূজনীয় গরু দেবের এই জীবনের সব কথা বলে শেষ করতে বহু, সময়ের প্রয়োজন হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ, তাঁর সঙ্গীতজীবনের বহু, প্রয়োজনীয় সংবাদ, যা এখনো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে, তাকে প্রকৃত ঐতিহাসিক এবং গবেষকদের মত নিষ্ঠার সঙ্গে খুঁজে বের করতে হবে, প্রথমে। এর সঙ্গে প্রয়োজন হবে ঊনবিংশ শতকের বাংলা-সঙ্গীত-সংস্কৃতির ইতিহাসের সঙ্গে বাংলাভাষায় রচিত যাবতীয় গানের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের। শিক্ষকতার কাজের অবসরে গরু দেবের সঙ্গীত-জীবন, বাংলা সঙ্গী- তের ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ এবং বাংলার বিচিত্র সঙ্গীতধারার সঙ্গে পরিচিত হবার পক্ষে কিছু দূর অগ্রসর হবার পরই আমি এর প্রয়োজনীয়তা পরিষ্কারভাবে অনুভব করতে সক্ষম হই। আমার একার চেষ্টায় এতবড় কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। বহুজনকে উৎসাহের সঙ্গে একাজে হাত দিতে হবে। এবং এইরূপে সমবেত প্রচেষ্টার ফলেই জানা যাবে যে, গত শতাব্দীর বাংলা সঙ্গীত-সংস্কৃতির স্রষ্টা-উত্তরাধিকারী রূপে, বিশেষ করে গর দেবকে এবং গত শতাব্দীর সঙ্গীতধারাকে নতুন যুগের উপযোগী করে গড়ে তোলার দ্বারাই তাঁর এই সৃষ্টির সার্থকতা। ঊনবিংশ এবং বিংশশতকে প্রকাশিত বাংলাভাষার নানা প্রকার সঙ্গীতগ্রন্থ এবং গত শতাব্দীর বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনধারার ব্যাপক পরিচয়ের উপযোগী বেশ কিছ, ঐতিহাসিক গবেষণাগ্রন্থ এবং প্রবন্ধাদি পড়বার সূযোগ আমার হয়েছিল। “রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা” গ্রন্থের প্রবন্ধ ক'টির রচনা কালে সেইসব গ্রন্থ ও প্রবন্ধাদি থেকে আমি প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। আমার সেই ঋণ আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি। এছাড়া, কৃতজ্ঞ আমি শ্রীযুক্ত সাগরময় ঘোষ ও শ্রীযুক্ত অমিতাভ চৌধুরীর কাছে, যাঁদের উৎসাহ ও সাহায্যে “রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা” গ্রন্থটির দ্রুত প্রকাশ সম্ভব হলো।
জন্ম : ২৪ বৈশাখ, ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। পিতা—স্বদেশকর্মী ও শ্রীনিকেতনের রূপকার কালীমোহন ঘোষ, মাতা—মনোরমা দেবী। এক বছর বয়স থেকে শান্তিনিকেতনে। সেখানেই বিদ্যালয়শিক্ষা। শিশুবয়স থেকেই সংগীতে স্বাভাবিক-অনুরাগ ও শক্তিমত্তার পরিচয়, ফলে রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে সংগীতশিক্ষার সুচনা। হিন্দুস্থানি সংগীত শেখেন ভীমরাও শাস্ত্রীর কাছে। ১৯৩০ সালে বিশ্বভারতীর সংগীতশিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে সংগীতভবনের পরিচালক, ১৯৪৫-এ অধ্যক্ষ। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ১৯৫৪-তে রবীন্দ্রসংগীত ও নৃত্যের প্রধান অধ্যাপকের দায়িত্ব পান। ১৯৬৪-৬৮ এবং ১৯৭১-৭৩, দু’বার বৃত হন সংগীতভবনের অধ্যক্ষপদে। ১৯৭৪-এ অবসর। এরপর দু’বছর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রূপে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গবেষণার কাজ। ১৯২৬ সাল থেকে সংগীতের পাশাপাশি নৃত্যচর্চারও সূচনা। গুরুদেবের ইচ্ছানুসারে ১৯৩১-এ দক্ষিণ ভারতে কথাকলি নাচ শিখতে যান। ১৯৩৭-৩৯ সালে ক্যাণ্ডি ও জাভাবালীর নৃত্য শিখতে যান সিংহল, বর্মা ও ইন্দোনেশিয়ায়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর বিভিন্ন নাটকের অভিনয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি, নৃত্যনাট্য প্রযোজনাতেও হয়ে ওঠেন গুরুদেবের প্রধান সহায়ক। বহু সম্মানভূষিত জীবন। ১৯৭৭-এ সংগীত নাটক আকাদেমির ফেলো। ১৯৮০ সালে সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার। ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ ১৯৮৪। ওই বছরই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত দেশিকোত্তম। রচিত গ্রন্থাদির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য : রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত বিচিত্রা, Music and Dance in Rabindranath Tagore's Educational Philosophy. সহধর্মিণী : শান্তিনিকেতন কারুসংঘের অন্যতম শিল্পী ইলা ঘোষ।