প্রস্তাবনা
দ্বিপদী, ম্যাক্সিম, শের শায়েরি; আমার মতে কেবল সাহিত্যেরই না বরং মানুষের মনোগত আনন্দ-বেদনা প্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম। খুব অল্প কথা দিয়ে যা প্রকাশ করা হয়, বিস্তারিত ব্যখ্যা দিয়েও তা অনেক সময় করা সম্ভব হয় না।
সম্ভবত হিন্দি সিনেমা দেখার কারণেই এক সময় ‘শের-শায়েরি’ ভালো লাগতে শুরু করে। আজকের দিনের হিন্দি গান, কথোপকথনে যে শব্দ ব্যবহৃত হয় তার অনেকাংশই মূলত উর্দু শব্দ। রাজনৈতিক কারণে উর্দু আমাদের কাছে স্পর্শকাতর একটি ভাষা। কিন্তু শের শায়েরি চেনার পর খেয়াল করেছিলাম, উর্দু বাস্তবিকই একটি স্পর্শকাতর ভাষা, তবে সেটা ইতিবাচক অর্থে। গালিব থেকে শুরু করে একে একে পরিচিত হয়েছিলাম মীর, খুসরো, যওক, দাগ দেহলভী, আকবর এলাহাবাদী, সাহির লুধিয়ানভির সঙ্গে। গুলযার ও জাভেদ আখতার তো গীতিকার হিসেবে পরিচিত ছিলেনই।
তবে, সে অনেক কাল আগের কথা। তখন বই-পত্র খুঁজে পাওয়ার সব রাস্তাঘাট জানা ছিল না। তাই যখনই কোথাও কোনো শের শায়েরি পেতাম, ডায়েরিতে টুকে রাখতাম। সেখান থেকেই এক সময় মনে হয়েছিল এগুলো নিয়ে একটা সংকলন করা যেতে পারে। অনেকে বলেছিলেন যে, আমার ‘ভাবানুবাদ’ ভালো হয়।
শের শায়েরি সাধারণত উর্দুতে হয়। হিন্দিতে কিছু হয়েছে, তবে তার সাহিত্যমান উর্দু শের শায়েরির মতো উঁচু নয়। আমার কাছে উর্দু ভাষার মূল মাহাত্ম্য এর ঝংকারে, এর লালিত্যে। উর্দু যারা শুনেছেন সহীহ্ উর্দুভাষীর মুখে, তিনি জানবেন উর্দু একাধারে ঝংকার ও কোমলতার মিশ্রণে তৈরি। মোগল সেনা ছাউনিতে জন্ম (বিতর্ক হতে পারে) এবং বেড়ে ওঠা এই ভাষায় যেমন আছে পারস্যের গোলাপের গন্ধ, তেমনই আছে বাংলার নদীর কল্লোল।
অনুবাদের ক্ষেত্রে বরাবরের সমস্যা মূলভাব ধরে রাখা, সে যে ভাষাই হোক। কোনো শের বা শায়েরি বাংলা অনুবাদে আনতে গেলে সেখানে সারকথা আনা সম্ভব হলেও অনুবাদে উর্দুর সেই ঝংকার থাকে না। বহু সময়ে বহুজনের করা অনুবাদ পড়েছি, কিন্তু সন্তুষ্ট হইনি। তাই বলে আমার এটাই এযাবৎকালের সেরা কাজ, এমন দাবি করছি না। কিন্তু এই দাবি করছি যে মূল অর্থের কাছাকাছি থেকে উর্দুর আবেশ পৌঁছে দেওয়ার যথাসাধ্য এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।
আরেকটি বিষয় হলো এই সংকলনের শের-শায়েরি বাছাই। এখানে উর্দু ভাষার সেরা কবি মীর্জা গালিব, তাঁর পূর্ববর্তী মীর তকী মীর এবং খুসরোর শের রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে কবির দাসের দোঁহা। শের এবং দোঁহা ভাষাগত দিক হতে আলাদা। কিন্তু কবিরকে আমি গালিব, মীরদের সঙ্গে রেখেছি মরমী বক্তব্যের জন্য। এমনকি এই সংকলনে উক্ত কবিদের মরমী অর্থ ধারণকারী দ্বিপদীগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছি। মানুষ, মানবতা, ঈশ্বর নিয়ে কথা বলেছেন এরা সকলে। এখানে সংকলিত প্রায় প্রতিটি শের শায়েরিতে কোনো না কোনো গূঢ় বক্তব্য রয়েছে।
কবিদের কাব্যের প্রধান একটি বিষয় প্রেম। গালিবের অধিকাংশ ‘শের’ পড়লে মনে হয় তিনি কোনো প্রেমিকার তরে প্রাণপাত করে চলেছেন। মীরেরও তাই। কিন্তু গভীর করে ভাবলে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় স্রষ্টাকে। কখনো আবার পরাধীনতার শিকল কেটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। সময়ের সাথে এগিয়ে চলতে চলতে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আরেকজনকে, যিনি তাঁর কবিতায় প্রেমের মাঝে দ্রোহ ধারণ করেন, দ্রোহের মাঝে প্রেম। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ এক সময় হয়ে ওঠেন আমার অন্যতম প্রিয় কবি। দ্রোহ হোক বা গীতি, বাদ পড়েননি সাহির। আর গুলযার এসেছেন শেষ সময় অবশ্যম্ভাবী হিসেবে।
ফিরাকে থাকা ‘অনুবাদ’ সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন বোধ করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখেছি আমার পড়া অনূদিত শের শায়েরি বাংলায় শুনতে সুন্দর হলেও মূলগত অর্থ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। উর্দু ভাষার বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গের অনেক খ্যাতনামা ও পারদর্শী ব্যক্তি বা নামকরা গালিব, মীর, ফয়েজ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত অনুবাদক, গবেষকদের কাজে তুষ্ট হতে পারিনি। বর্তমান বইয়ে তাই বাংলা অনুবাদে বাংলার লালিত্য যথাসম্ভব ধরে রেখে মূলের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। কিন্তু গালিব, মীর, খুসরো, কবিরদের দ্বিপদী এতো গভীর অর্থ বহন করে, যা কিছুটা ব্যাখ্যা না করলে অনেক ক্ষেত্রে বোঝা কঠিন। তাই আমার যৎসামান্য বোঝাপড়া থেকে কিছু ব্যাখ্যা যোগ করেছি, যা নাতিদীর্ঘ।
উর্দু (গালিব, মীর, খুসরো) এবং কবিরের দোঁহা বাংলায় লেখার ক্ষেত্রে, উচ্চারণ এবং শ্রুতি যেমন হয় আমি তেমন করে লিখেছি। আমার বিশ্বাস যারা উর্দু কিংবা নিদেনপক্ষে হিন্দি বোঝেন তাদের কাছে বাংলায় লেখার ক্ষেত্রে ‘ক্যয়সী’ হতে ‘ক্যায়সী’ পড়তে ভালো লাগবে। আসলে জের জবরবিহীন উর্দু ভাষার উচ্চারণ আমাদের ‘অ’-কার, ‘আ’-কারের মধ্যবর্তী হয়। কিন্তু ‘কিতনা প্যায়সা হুয়া?’ কথাটিকে আমি ‘কেতনা প্যয়সা হুয়া?’, কিংবা ‘কাব তাক ল্যড়রে র্যহে খুদ সে’ কে ‘কব তক লড়তে রহে খোদসে’ লিখতে আগ্রহী নই। শ্রদ্ধেয় আবু সয়ীদ আইয়ুব কিংবা অন্যদের বাংলা অক্ষরে লেখা উর্দু মূলানুগ হলেও আমার কাছে বিরস মনে হয়েছে। আমি সঠিক কী বেঠিক, তা পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এইটুকু মনমানী এই বইয়ের ক্ষেত্রে করেছি।
শের-শায়েরির অনুবাদ অনেক আগে থেকে করি। ২০১৪/১৫ সাল হবে। তখন হয়তো আরও কাঁচা ছিল কাজ। তবু ঘনিষ্ঠজনদের প্রশংসা পেতাম। পাণ্ডুলিপি গোছানোর আয়োজন হয়েছিল সেই ২০২০ থেকে। শুরুতে ছিলেন গালিব, মীর, খুসরো, কবির। তাদের ছাড়াও ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতাও যোগ করেছিলাম। নানা কারণে বই প্রকাশ হয়নি। এর মধ্যে আরও অনেক কবির কবিতা পড়া হয়। সেই সূত্রে যুক্ত হয়েছেন সাহির লুধিয়ানভি, আহমাদ ফারায ও গুলযার।
প্রত্যেক কবির জন্য আলাদা অধ্যায়ের মতো করে তাদের শের/কবিতা উপস্থাপন করেছি যার শুরুতে কবির সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। এরপর তাঁদের শের বা কবিতার সংকলন। ইচ্ছে ছিল কিছু হিন্দি গানের অনুবাদ যুক্ত করার। কেননা আমাদের অনেকেরই ধারণা হিন্দি গান মানেই বাজারি গান। তাই জানানো প্রয়োজন ছিল যে অনেক হিন্দি গানও চমৎকার অর্থ বহন করে। এ পর্যায়ে সে সুযোগ হলো না। ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল হয়তো।
পরিশেষে উল্লেখ্য, আমি কোনো নির্দিষ্ট বই থেকে শের-শায়েরি বাছাই করিনি। এগুলো বিভিন্ন সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আলাদা স্থান হতে সংগ্রহ করা। কখনো সিনেমা, কখনো গান, কখনো ইন্টারনেট, কখনো কোনো বইয়ের মাঝে থাকা দুই লাইন। সেগুলো টুকে টুকে নিজের মতো অনুবাদ করেছি। উর্দুর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার নেই। তবে বহু বছর আগ্রহ ভরে শুনে শুনে বাংলা আর হিন্দির সাথে অনেকখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষাটিকে মোটামুটি ভালো বুঝি। সে সাহসেই এই অনুবাদ সংকলন প্রকাশ।
নামকরণ প্রসঙ্গে বলতে হয় কিছু কথা কেননা ‘ফিরাক’ শব্দটি পাঠকের অপরিচিত। ‘ফিরাক’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘বিচ্ছেদ’, কখনো ‘বিরহ’। তবে শব্দটি স্থানভেদে অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হয় ‘মানসিক অস্থিরতা’, কিংবা কখনো ‘গভীর চিন্তা’ হিসেবেও ব্যবহার দেখা যায়। এখানে ‘বিরহ’ অর্থেই ‘ফিরাক’ ব্যবহার করছি। কেননা এ সংকলনে থাকা বহু দ্বিপদী, বিরহের বেদনা বহন করে। সে বিরহ কখনো প্রেমিকার, কখনো স্রষ্টার।
মাহমুদুর রহমান