জাতীয়তাবাদ শব্দটি পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আপনাপন ভূখন্ড সম্প্রসারণের জন্য এক ধরনের জাতীয়তাবাদের কথা উত্থাপন করেছিল বিভিন্ন সময়ে। এই জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বংশের মূলগত একটি বৈশিষ্ট্য যাকে ইংরেজিতে এথনিসিটি” (ঊঃযহরপরঃু) বলা হয়। যেমন ধরা যাক জার্মানী জাতি। এক সময় এই জাতি সমুদ্র পার হয়ে ইংল্যান্ডের ভৌগোলিক সীমানায় নিজেদের বিস্তার করেছিলেন। আমরা ইংল্যান্ডের ভাষা যদি পরীক্ষা করি তাহলে শুরুতে ওল্ড জার্মানী ভাষাকে পাই। পরবর্তীতে এটা পরিবর্তিত হয়ে অ্যাঙ্গো স্যাকশন রূপ ধারণ করে। এভাবেই একটি জাতিসত্তা বিবিধভাবে নিজেকে প্রসারিত করে নতুন নতুন জাতিসত্তা নির্মাণ করেছে। কোন জাতিসত্তাই চিরকাল অপরিবর্তিত থাকে না। ক্রমশ তার পরিবর্তন হয় এবং নতুন নতুন ক্ষেত্রে গিয়ে এই জাতিসত্তার বলিষ্ঠ বিভাজন হয়ে থাকে। হিটলার যে আর্য জাতিসত্তার কথা বলেছিলেন এবং যে জাতিসত্তা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেছিল তার ফলে একটি বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়। এটা মনে রাখতে হবে যে মৌলিক যে জাতিসত্তা থাকে সেই জাতিসত্তা বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে তার রূপের বিবর্তন ঘটে এবং পরিশেষে ভৌগলিক সীমানা-লব্ধ একটি নতুন জাতিসত্তায় পরিণত হয়। আমেরিকায় অনেক দেশের লোক এসে অনেক জাতির প্রভাব নিয়ে বহুকাল বসবাস করছেন এবং একটি ভৌগোলিক প্রশাসনের মধ্যে সমন্বিত রূপ পাচ্ছে। নিগ্রোরা এসেছিল দাসরূপে এবং ইউরোপীয় বহু দেশের মানুষ এসেছিল নিজেদের জন্য সৌভাগ্য গড়ে তুলতে। এভাবে আমেরিকায় জাতিসত্তাগত বিভিন্ন বিশ্লেষণ একীভ‚ত হয়ে একটি ভৌগোলিক জাতিসত্তায় পরিণত হয়েছে। এটাই জাতিসত্তার ধর্ম। ব্রাজিলে পর্তুগীজরা এসেছিল, তারপর এসেছিল গোপনীয়রা, এক সময় কিছু আরবরাও এসেছিল। পরিশেষে জাপানীরাও এসেছিল। এভাবে বিভিন্ন জাতিসত্তা মিলিত হয়ে ব্রাজিলের জাতিসত্তা নির্মাণ করেছে এবং বর্তমানে একটি ভৌগোলিক জাতিসত্তায় পরিণত হয়েছে। ব্রাজিলের আদিম অধিবাসীরা এখনও আমাজান নদীর তীরে বসবাস করে। তারাপতিত এবং অগ্রাহ্য হয়েছে। এই অগ্রাহ্য হওয়ার কারণ হল প্রথমত তাদের সংখ্যা কম ছিল; দ্বিতীয়ত অস্ত্রশস্ত্র আধুনিক ছিল না; তৃতীয়ত বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্র না থাকার দরুণ তারা অন্তর্গত নিষ্ঠার মধ্যে লুক্কায়িত ছিল। তাদের জীবনে আদিম যুগ প্রবাহমানতার সংকল্পের মধ্যে তারা আদিমকাল থেকে বসবাস করছিল। ইউরোপের লোকেরা যখন ব্রাজিলে এলো তখন শক্তির দর্পে এবং ক্ষমতার দর্পে নিজেদের জন্য নতুন বাসভ‚মি নির্মাণ করলো এবং ব্রাজিলকে নিজেদের আয়ত্তে আনলো। সংকল্প এবং শক্তি তাদেরকে নতুনভাবে অধিকার দিল এবং দেশগত একটি নতুন জাতিসত্তা তৈরি হল। এভাবেই সাধারণত মৌলিক জাতিসত্তার বিলোপ ঘটে এবং বিভিন্ন জাতি ভাষা ও বর্ণ নির্বিশেষে একটি বিশেষ সীমানার মধ্যে নতুন জাতিসত্তা নির্মাণ করে এটাই মৌলিক সত্য। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। এর একটি ভৌগোলিক সীমানা আছে। সেই সীমানার মধ্যে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ বাংলাদেশের সঙ্গে । এই ইতিহাসগত, সংস্কৃতিগত এবং আকাক্সক্ষাগত। অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের সঙ্গে চ‚ড়ান্তভাবে । জাতিগতভাবে আমরা বিভিন্ন জাতিসত্তার সংমিশ্রণ। এক সময় জাতি বাংলাদেশে বসবাস করত। সে কখন কোন যুগে তা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। বর্তমানে ছোট নাগপুরে বাস করে। তারা যে কি করে ছোট নাগপুরে গেল এবং বাংলাদেশের আশ্রয় চিরকালের জন্য ছেড়ে দিল তার ঐতিহাসিক বিবরণ কোথাও নেই। কিছু কিছু শব্দের মধ্যে অংক গণনার মধ্যে এবং স্থানবাচক নামের মধ্যে প্রমাণ পাওয়া যায় যে এদেশে এককালে বাস করতো। আর্যাবর্ত থেকে যারা এসেছিল তারা এদেশে চিরস্থায়ীভাবে থাকেনি এবং এদেশকে অনার্য দেশ বলে অভিহিত করেছিল। এর ফলে বাংলাদেশের একটি স্বাতর্ন্ত্য অনুভব করা যায়। বহু প্রাচীন যুগে বাংলাদেশের মানুষ যে সমস্ত জীবিকা অবলম্বন করেছিল সে সমস্ত জীবিকার কারণে তারা আর্যদের দৃষ্টিতে শ্রেণির মানুষ হিসেবে গণ্য হল। প্রাচীন দোহাকোষে এবং বৌদ্ধগানে এদের অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। পরে ক্রমশ বহিরাগতদের আবির্ভাব ঘটলো। কাক্সগুকুজ এবং কর্নাটক থেকে ব্রাহ্মণরা এলো।