কালপরিক্রমণে জৈবরাজনীতি এবং ভূ-সংস্কৃতির প্রভাবে কবিতাকে আমরা বিচিত্রভাবে চিনি, নানানরূপে, আঙ্গিকে ও ভাষায় ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করি। এই যেমন: সনেট, সেস্টিনা, কোয়াট্রেন, ম্যাঙ্মি, রুবাই, হাইকু, ছন্দোবদ্ধ কবিতা, অনুকাব্য, মহাকাব্য, গদ্যকাব্য, গীতিকাব্য, শতপদীকাব্য, শের, শায়রী এবং দীর্ঘকবিতা ইত্যাদি।
এছাড়া অতিবাস্তবতা, রূঢ়বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা ও যাদুবাস্তবতার লড়াই তো লেগেই আছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় এবং আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার গ্রহণ ও বর্জনের প্রতিযোগিতায় কেউ কারো থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এ সবের মধ্যেই আমরা চর্চা চালিয়ে যাই; কেউ সফল হই, কেউবা আবার মাঝপথে হারিয়ে যাই।
কবিতার অহেতুক তর্ক নিয়ে আমার আগ্রহ বরাবরই নাই বললেই চলে, দশকের এলার্জিও আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনও। মূলত আমি লিখে ও পড়ে আনন্দ পাই। তাই লেখালেখি ও পঠন-পাঠনের আনন্দটুকু সঙ্গে নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই। এর ফলে কে আমাকে নর্দমায় ছুড়ে ফেললো, কে আবার মাথায় তুলে স্তুতি পাঠ করলো সে সব নিয়ে ভাবনাচিন্তার ফুরসতই খুঁজে পাই না।
হতে পারে নিজের প্রয়োজনে অথবা পাণ্ডিত্য প্রমাণে কিংবা স্বতন্ত্র পথ বিনির্মাণের তাগিদ থেকে কবিতাকে নানা রকম রূপ দানের চেষ্টা করে কবি। কিন্তু দিনশেষে কবিতাকে কোনো পাঠকই নির্দিষ্ট একটি ফর্মেট দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে না, কোনো নাম-ছক দিয়েও শনাক্ত করে না। কেবলমাত্র শিল্প-সৌকর্য, স্বতন্ত্রকলা, বিন্যাস-প্রকরণ, দর্শনতত্ত্ব ও উদ্ভাবনী শক্তিমত্তা দিয়েই কবিতাকে বিচার করা হয়-এর বাইরে অন্য কিছু নয়। এখানে পূর্বপুরুষদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা আভিজাত্য ফলানোর সুযোগ নেই, বয়স অথবা কোটার সুবিধাও নেই। মুখ্যত, রন্ধন ক্রিয়ার মেরিনেশনের মতো যে যতটা বৈচিত্র্য আনতে পারে, তার কবিতা ততটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
অনেকেই মনে করেন, কবিতা ব্যাকরণ মানে না। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, আবার একেবারেই মিথ্যেও নয়। তবে তর্কের খাতিরে অনেক কথা বলা গেলেও, ইনফ্রানস্ট্রাকচার সুগঠিত না হলে, শব্দ ও বাক্যের জুতসই ব্যবহার না থাকলে কবিতার স্বাদ পানসে হবে এটাই স্বাভাবিক। এমন চর্চা কখনও কখনও পণ্ডশ্রমেও পরিণত হতে পারে। কেননা, অমার্জিত পরিকাঠামো কখনও বিশুদ্ধ শিল্পের সৌরভ ছড়াতে পারে না।
ইমার্সিভ আর্ট ইনস্টলেশনের প্রদর্শনীর মতো ক্ষুদ্রতম ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে অনন্তকালের ছাপচিত্র এঁকে রাখে কবিতা। প্রেম-বিহর, দ্রোহ-খেদ, আ¶েপ-আখ্যান, ক্রোধ-উচ্ছ্বাস, সারল্য ও ক্ষিপ্রতা যেই উপাদানই থাকুন না কেন, কবিতা আদতে নির্মলতার প্রতীক; মানবিক স্থূলতারোধী, নির্ভরতা ও পরিশুদ্ধতার বাথান। গাঁথুনিশৈলি, দৃশ্যকলা, রূপ-রস ও বয়নকৌশল ভিন্ন ভিন্ন হলেও নির্মাণসূত্রের মেটাল ফেব্রিকেশন প্রায় অভিন্ন। কবিতা এতটাই দুর্বল ও সহজলভ্য শিল্প নয় যা গোগ্রাসে গিলে ফেলা যায়; আবার এতটাই কঠোর-দুর্বোধ্য উপাদানেও ঠাসা নয় যে সেটা হজম করতে গেলে কিনোয়ার দানা পেটে পুরতে হয়। তবলের খিরনের মতো মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করেও চারপাশে ঝংকার তোলার শক্তি যোগায় যে, আমরা তো কেবল তাকেই কবিতা বলতে পারি।
একজন কবির কখনও অ্যাক্রোফোবিয়া তথা উচ্চতা ভীতি থাকে না, সীমানা প্রাচীর থাকে না। তাকে স্বপ্ন দেখাতে হয়, নিজেও স্বপ্ন দেখতে হয়। মেডিটেশন, নির্জনতা, ভ্রমণ-তৃষ্ণা, সাহস ও উদ্যমতা তাকে নতুন পথের সন্ধান এনে দেয়।
যার কলমের ডগায় পৃথিবীকে গলিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী এনজাইম লুকিয়ে থাকে, আমরা তো কেবল তাকেই কবি বলে ডাকি। জগতে একমাত্র কবিই পারে চোখ বন্ধ করে আন্দিজ পর্বতমালা ডিঙিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের শেষ মৃত্তিকার ওপর দাঁড়িয়ে আলবাট্রস পাখির সঙ্গে নৃত্য-উল্লাসে মেতে উঠতে। তার অর্ন্তদৃষ্টির আলোকছটা উপরে-নিচে, ডানে-বাঁয়ে এবং সামনে-পেছনে সমান তালে প্রতিফলিত হয়। যদিও অলৌকিক কিছু শব্দ, গন্ধ ও ছায়া তাকে সব সময় ঘিরে রাখে, তারপরও হ্যালুসিনেশনের কালোরেখা তার কাব্যসত্তাকে বিনষ্ট করতে পারে না। ফলে ঘুমহীন চোখে সে ঘুম নামায় এবং ঘোরতর নিন্দ্রার ভেতরেও জেগে থাকার শক্তি পায় সে। কারণ, বর্ষণমন্দ্রিত রাত কবিকে ভাবনা দেয়, শরতস্নিগ্ধ মেঘের শুভ্রতা স্বপ্ন জাগায়, শিশিরঘন হেমন্তের আলোছায়া প্রেরণা যোগায়, গ্রীষ্মমথিত রোদ্দুরের তীব্র ঝাঁঝ প্রাণসঞ্চার করে, কুয়াশা-মোড়ানো শীতল পিরামিড দৃঢ়তা বাড়ায় এবং বসন্তমাতাল ফুল ও পাখিরা দেয় শব্দ ও ভাষা।
পথ হাঁটতে গিয়ে পথিক যেমন পথের ইতিহাস ও যোগ্যতা তালাশ করে না। তেমনিভাবে কবিতা পড়তে গিয়েও পাঠক কখনও কবিতার যুগ, ধারা, ফর্মেট কিংবা দশক বিবেচনা করে থমকে দাঁড়ায় না। এরপরও গতানুগতিক ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে, নতুনত্বের নির্যাস পেতে এবং কালকে ঋদ্ধ করে রাখতে বিভিন্ন সময় কবিদেরই হাতে নতুন নতুন কাব্যধারার উদ্বোধন ঘটে। যার ফলে কাব্যের রস ও সৌন্দর্য বিকশিত হয়; ভাব ও প্রকাশ নান্দনিকতা পায়, বুননের অঙ্গসৌষ্ঠব দ্যুতি ছড়ায় এবং ভাষার গতিস্রোত তীব্রতর হয়। আরোপিত শব্দের ঝনঝনানি, অযৌক্তিক উপমা-উৎপ্রেক্ষার বাহাদুরি, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অনীহা প্রদর্শন এবং ধার করে আনা চিন্তাচেতনার প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরতার প্রভাব কবিতার অঙ্গহানি ঘটায়; এতে বরং শিল্পসত্তার তারল্য সংকট দেখা দেয়।
আমি মনে করি, প্রকৃতির ইকোসিস্টেমের মতোই কাব্যের ধারা আপন গতিতে প্রবহমান; একটার বিনাশ ঘটে এবং অন্যটার উত্থান ঘটে। এরপরও অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এমন একটা নিবিড়তম যোগসূত্র লেগেই থাকে যে-এর ইভ্যালুয়েশন করা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ে।
মূলত মানুষের মুখের ভাষা ও জীবনধারাকে শৈল্পিকভাবে তুলে ধরাটাই হচ্ছে কবিতা; যা হাজারও তর্কবিতর্কের ভেতরে এবং সময়ের বিচারে পাঠক-মন সানন্দে গ্রহণ করে নিতে পারে। কবিতার সুনির্দিষ্ট কোনো চেহারা-সুরত নেই, বাধ্যতামূলক বিধান-প্রবিধান নেই এবং দেখেই চেনা যাবে এমন কোনো আকার-আকৃতিও নেই। সুতরাং কবিতাকে সব সময় নিজের যোগ্যতা দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, কবিকে নিজের শক্তিমত্তা দিয়েই কালের তীব্রতর স্রোতের প্রহার সহ্য করে করে টিকে থাকতে হয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই- প্রকৃতি, প্রেক্ষাপট, ধর্মতত্ত্ব, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং কালের দাবি মেটাতে বহুবিধ ইজমচিন্তার জন্ম হয়েছে। যেমন: সুফিজম, রিয়্যালিজম, স্যুরিয়্যালিজম, ম্যাজিক রিয়্যালিজম, অ্যাবসার্ডইজম, ইমপ্রেশনিজম, কিউবিজম, ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, ফিউচারিজম, পোস্টমর্ডানিজম, আইডিয়্যালিজ, মেটারিয়ালিজম ইত্যাদি। মূলত, কবিতা সুনির্দিষ্ট কোনো ফ্রেমে কিংবা দর্শনে আটকে রাখার জিনিস নয়। কবিতার চিন্তা ও দর্শন সর্বদাই অবারিত। আদতে অতিরিক্ত ইজমচিন্তা নির্বিষ পুঁয়ে সাপের মতো তেল চিটচিটে শরীর দেখানোর কসরত ছাড়া আর কিছু নয়- যা খুব দ্রুত ভীতিপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারলেও পরক্ষণেই সে সব ভয়ভীতি মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। আগে কবিতার জন্ম হয়, তারপর সেটা কোন ফ্রেমে বাঁধা যায় সেই ধারণা তৈরি হয়। পৃথিবীতে কবিতার অস্তিত্ব না থাকলে কি কোনো ইজমচিন্তার অস্তিত্ব থাকতো? এরপরও এসব কাব্যধারণাকে ফেলনা ভেবে উড়িয়ে দেওয়ার মতো শক্তিসামর্থ্য আমার নাই।
না ফেরার ব্যাকরণ- কাব্যগ্রন্থটি পড়ার পর পাঠক আমাকে কিছুটা স্ব-বিরোধী ঘোষণা করলেও দোষের কোনো কারণ দেখছি না। কারণ, যেখানে আমি নিজেই গ্রীবাদেশ ফুলিয়ে অত্যন্ত গৌরব মিশিয়ে বলেছি, দিনশেষে কবিতাকে পাঠক নির্দিষ্ট কোনো ফর্মেট দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে না। বিচার করে শিল্প-সৌকর্য, স্বতন্ত্রকলা, বিন্যাস-প্রকরণ, দর্শনতত্ত্ব ও উদ্ভাবনী শক্তিমত্তা দিয়ে। সেখানে আমি নিজেই এ বইয়ের সরল-স্বাভাবিক কবিতাগুলির ফাঁকে ফাঁকে কিছু ম্যাঙ্মি, সনেট, সেস্টিনা, কোয়াট্রেন, রুবাই, হাইকু, অনুকাব্য এবং দীর্ঘকবিতা ঠাঁই দিয়েছি। কেন দিয়েছি? জানি না। এটাকে যদি কেউ ম্যানিয়াক টাইপের আচরণ আখ্যা দিয়ে খানিকটা বিদ্রূপ করে তাতেও আমার অভিযোগ থাকবে না।
আমার সরল স্বীকারোক্তি, মন থেকে প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করলাম বলেই বইটিতে ভ্যারিয়েশন আনার জন্যে একটু পাণ্ডিত্য প্রমাণের চেষ্টায় মেতেছি। তবে এই পাণ্ডিত্য প্রমাণের প্রয়াস যেন কোনোভাবেই ধৃষ্টতায় রূপ না নেয় সেদিকটাতেও খেয়াল রেখেছি। বাকিটা বিচার করবেন আপনারা।
রফিকুজ্জামান রণি