বহুকাল পূর্বে অন্তঃশীলা নামে একটি জটিল, বুদ্ধিবৃত্তিক উপন্যাস পাঠ করেছিলাম, বাংলা ভাষার প্রখ্যাত মননশীল লেখক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা। সম্প্রতি পড়া হল একই নামের আরেকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি; পার্থক্য এটি একটি কাব্যগ্রন্থ এবং তা একজন নারীর লেখা। তাই বলে এতে বুদ্ধিবৃত্তির কোনো খামতি রয়েছে সেটি বলার উপায় নেই, বরং কবিতার অন্তঃশীল আবেগ ও অনুভূতির স্পর্শে তা এক নতুন মাত্রা পায় এখানে। তদুপরি ফাহমিনা নূরের কবিতা মানেই নম্র ও নমিত, গাঢ় ও গভীর এবং একইসঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল, শাণিত। তাঁর কবিতা যতটা স্থানীয়, ততটাই বৈশ্বিক; যতটা ব্যক্তিগত ততটাই সামষ্টিক। আর তাই এর আবেদন সুদূরপ্রসারী ও বহুবিস্তারী।
ফাহমিনা যখন তাঁর কবিতায় এমন উচ্চারণ করেন, “স্তব্ধতার ভেতর যে তিমিরনাদ ধ্বনিত হচ্ছে/ তাকে কী বলা যায়? বেঁচে থাকার কোলাহল?/ হুইসেল বাজিয়ে তিরোহিত হচ্ছে বিকেলের রোদ।/ শব্দ থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন শব্দ, ধ্বনি-/ কান পাতলে বাদাবন, নৌকার ছলাৎ,/ বাতাস বিলাচ্ছে পূর্বপুরুষের নোনা ঘ্রাণ/ শরীরে মাটির ডাক, আড়িপাতা শকুনের কান/ কান পাতলেই আমাদের জন্ম-চিৎকার।”, তখন আমরা বুঝে নিতে পারি, তিনি নতুন শব্দ ও ধ্বনির জন্ম দিতে এসেছেন, যার জন্ম-চিৎকার শুনতে হয় আমাদের নিবিড় ও নিবিষ্ট কান পেতে, কেননা তার তিমিরনাদ ধ্বনিত হয় কেবল প্রগাঢ় স্তব্ধতার ভেতরেই।
ফাহমিনার কবিতা-কান্তারে চোখ পাতলে একদিকে যেমন আমাদের চিরচেনা জীবনানন্দীয় নিসর্গের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই আমরা পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গের পুরাণকথায়; তেমনি সেখানে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় সময়ের সিডেটিভ, বিষণ্ন অ্যাক্যুরিয়াম, মাইগ্রেন, মরফিন, মেটামরফোসিস, ডিমেনশিয়া, প্যারাবল, হারাকিরি, হ্যালুসিনেশান, ক্যানারি, কিউবিজম, অরিগ্যামি, আভালান্স, অ্যান্ড্রোমিডা ও অক্সিজেন মাস্কের মোহিনী আড়াল ভেদ করে নগরজীবনের যত ক্লেদ ও ক্লান্তি, বিভ্রম ও বিচ্ছেদ, প্রেম ও পারক্যের প্রতিধ্বনি। তাঁর পক্ষেই তাই এমন সপাটে বলা সম্ভব হয়: “যুদ্ধ চাইনি ব’লে সেই কবে থেকে/ সমাধিস্থ হয়ে আছি/ যুদ্ধ চাইনি ব’লে/ ক্যাপাডোসিয়ার শুষ্কতা নিয়ে/ উড়ে গেছি প্যালিওলিথিক যুগে/ যুদ্ধ চাইনি ব’লেই/ ক্রমাগত যুদ্ধের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি।”
কবি ফাহমিনা নূর তাঁর এই যুদ্ধবিরোধী তুমুল কবিতাযুদ্ধে সর্বাংশে জয়ী হবেন, এমত প্রত্যাশা ও প্রার্থনা আমাদের সকলের।