"ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত"বইটির ভূমিকা: আসকার ইবনে শাইখ মূলতঃ একজন নাট্যকার হিসাবেই সুপরিচিত। বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে নাটক রচনা, মঞ্চায়ন, অভিনয় ও পরিচালনার ক্ষেত্রে একটানা অবদান রেখে তিনি নাটকের ক্ষেত্রে নিজেই এক জীবন্ত ইতিহাস হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নাটক ছাড়া সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গনেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা। তাঁর নাট্যপ্রয়াসের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ইতিহাস-আশ্রিত নাটক। ইসলামের ইতিহাস এবং বাংলা-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় অত্যন্ত জীবন্ত রূপে উঠে এসেছে তাঁর বিভিন্ন নাটকে। অথচ আশ্চর্য, কোথাও ইতিহাসের সত্য এতটুকু ক্ষুন্ন হয়নি। তাঁর বিভিন্ন ঐতিহাসিক নাটক-গ্রন্থ পড়তে যেয়ে বারবার মুগ্ধ হয়েছি ইতিহাস-গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য সাফল্যে। কিন্তু এবারে আর নাটকের মাধ্যমে নয়- বিশ্ব-ইতিহাসের এক তাৎপর্যময় অধ্যায়ই তিনি সরাসরি তুলে ধরেছেন “ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত” নামক গবেষণা-গ্রন্থের মাধ্যমে। একাদশ শতক থেকে ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত খৃস্টীয় ইউরােপ জেরুজালেম উদ্ধারের নামে মুসলিম-বিদ্বেষ সজ্ঞাত যে দানবীয় তাণ্ডবলীলা চালায় মুসলিম এশিয়া-আফ্রিকার বুক জুড়ে, বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যে, ইতিহাসে সেটাই ক্রুসেড হিসাবে পরিচিত হয়ে আসছে। সে ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটেছিল ত্রয়ােদশ শতকে মুসলমানদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু খৃস্টীয় ইউরােপ সে পরাজয়কে যে বহুদিন ধরে মেনে নিতে পারেনি তার প্রমাণ মেলে পরবর্তীকালে বারবার তাদের মুসলিম শক্তি নির্মূল অভিযান থেকে। ইতিহাসে এই পর্ব পরিচিত হয়ে আছে পরবর্তী ক্রুসেড’ নামে। পরবর্তী ক্রুসেড'- এর পরও দেখা যায় ‘আরও পরবর্তী ক্রুসেড’ | কিন্তু তারপর? আসকার ইবনে শাইখ খৃস্টান, হিন্দু প্রভৃতি অমুসলমান সূত্রের দলিল-দস্তাবেজ থেকেই প্রমাণ করেছেন, ক্রুসেড কখনও শেষ হয়নি। অন্ততঃ ১৯১৭ পর্যন্ত খৃস্টীয় ইউরােপের মন থেকে ক্রুসেড বিকার দূর হয়নি। আসকার আরও দেখিয়েছেন- ক্রুসেড এখনও শেষ হয়নি। বসনিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর তার প্রমাণ। আসকার ইতিহাস লেখেননি। একাদশ শতক থেকে আজ পর্যন্ত বিশাল সময়ের খৃস্টীয় প্রতীচ্যের মুসলিম-বিদ্বেষের ধারাবাহিক ইতিহাসের একটা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন তিনি। ইতিহাসের সাদামাটা বিবরণী তুলে ধরার চাইতে ইতিহাসের ধারার অন্তর্নিহিত সত্য আবিস্কার করা চিরকালই কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজে আসকার অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আসকার অমুসলিম সূত্রের তথ্য দিয়েই প্রমাণ করেছেন, একাদশ শতকের জেরুজালেম উদ্ধারের নামে নারকীয় তাবলীলা, আর শতকের পলাশী আর হাল আমলের বসনিয়া একই সূত্রে গাঁথা। মূলতঃ নাট্যকার বলেই বােধ হয় আসকারের গদ্য রচনা, এমন কি ইতিহাসের ভাষায়ও থাকে এক ধরনের নাটকীয় আমেজ, যার ফলে গদ্য পাঠ করতে যেয়েও গদ্যপাঠের হয়রানিতে ভুগতে হয় না। বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতিতে এ গ্রন্থ বিশ্বমুসলিমের চোখ খুলে দিতে বিপুলভাবে সাহায্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমি লেখক ও প্রকাশককে যথাক্রমে এই মূল্যবান গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনার জন্য আন্তরিক মােবারকবাদ জানাই।