ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা *এ দেশের জনপদের কোনো একটি ছোট্ট গ্রাম-গীর্জা-হাসপাতাল-স্কুল-বাজার ইত্যাদি নিয়ে যেখানে বাস করে একদল মানুষ। সেই নিরিবিলি গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ঢেউ এসে লাগে। ফাদার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন-তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। ব্যাপারটি টের পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করে ফাদারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে। হত্যাকান্ডের দিন জন্ম হয় মূর্ছনার।পেরিয়ে যায় বাইশ বছর। গাঁয়ের ছেলে অমিয় ঢাকায় পড়াশোনা করে। অমিয়র সঙ্গে প্রেম হয় মূর্ছনার। ওদের প্রেমের পথে বা৭দা হয়ে দাঁড়ায় সন্ত্রাসী সুব্রত্ মূর্ছনার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুব্রত খুন করে অমিয়কে, ক্রশবিদ্ধ ভঙ্গিতে ঝুলিয়ে রাখে গীর্জার সামনে। এই মর্মঘাতী বেদনায় মানব সেবার ধর্ম গ্রহণ করে না হয়ে যায় মূর্ছনা।একদিন প্রার্থনার সময় বোমা বিস্ফোরিত হয় গীর্জায়। নিহত হয় মূর্ছনার মা মেরিনা বাড়ৈ। বাবা-মা দু’জনকে হারিয়ে একা হয়ে যায় মূর্ছনা।কাজের ব্রতে ও চলে আসে পাহাড়ের পাদদেশের একটি গ্রামে। পরিচয় হয় পাহাড়ের নিচে বাস করা কয়েকঘর আদিবাসী পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে। এদের জীবনের দ্বন্দ্ব-বঞ্চনা-হাসি-কান্না খুব কাছ দেখে ধর্ম ও মানব সম্পর্ক ওর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই টানাপোড়েনের জীবনে মানবিক বোধে তৈরি হওয়া সম্পর্ক আবার প্রশ্নবিদ্ধ হয় একটি শিশুকে কেন্দ্র করে। ও নিজ গাঁয়ে ফিরে যেতে চায়। সেই শিশুকে মানব-তৈরি সংকটের দুর্যোগ থেকে আড়ালে রাখার জন্য।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।