১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মস্কোতে পৌঁছান। এ যাত্রায় কবির সঙ্গী ছিলেন হ্যার টিম্বার্স, কুমারী মার্গট আইনস্টাইন, শ্রীসৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীআরিয়াম উইলিয়াম্ (আর্যনায়কম্) ও শ্রীঅমিয় চক্রবর্তী। কবি ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৫ দিন মস্কোতে থাকেন। কবি এই প্রথম এবং শেষবার মাত্র একবারই-রাশিয়া ভ্রমণ করেন। অবশ্য এর আগে আরও দু'বার-১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে ভিয়েনায় থাকার সময়ে এবং ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে জাপানে থাকার সময়ে-রাশিয়া থেকে তাঁর নিমন্ত্রণ আসে। কিন্তু দুবারই শারীরিক অসুস্থতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে রাশিয়া ভ্রমণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে হয়। ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে কবি যখন জেনেভায় বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন তখন তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্যে অনেকেই তাঁকে রাশিয়া ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছিলেন। অবশ্য এই নিষেধের পিছনে ছিল কবির ইংরাজ বন্ধুবান্ধবদের স্বার্থপরতা। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের মত একজন মহামানব সে দেশ স্বচক্ষে দেখার পর তার প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে তাঁর মতামত ব্যক্ত করলে সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিজীবী সমাজে তার প্রভাব কতখাানি পড়বে। কিন্তু সোভিয়েট রাশিয়াকে স্বচক্ষে দেখবার ইচ্ছা কবির বহুকালের। রাশিয়া পশ্চিম দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কীভাবে দেশের সমস্ত মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির চেষ্টা করছে তা জানার গভীর আগ্রহ ছিল কবির।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।