"মেমসাহেব" বইয়ের ভূমিকার অংশ থেকে নেয়া: প্রায় অবাঞ্ছিতের মতােই গরিবের ঘরে আমার জন্ম । সাড়ে তিন বছর বয়সে আমার মাতৃবিয়ােগ । অকল্পনীয় দুঃখকষ্ট অবিচার। অত্যাচার সহ্য করেই একদিন যৌবনের মুখােমুখি এসে হঠাৎ সাংবাদিক হলাম। পুরাে বছর বেগার খাটার পর মাসিক ১০ টাকা। ভাতা হল, কিন্তু তাও আট আনা এক টাকার কিস্তিতে। তার পরও পদে পদে লড়াই। মােদ্দাকথায় ঠিক মধ্যবিত্ত ভদ্দরলােক বলতে যা বােঝায়, তা হলাম না বা হতে পারলাম না। প্রিয়জনদের কেউ বলেন ম্লেচ্ছ। হয়েছি, কেউ বলেন গােল্লায় গেছি। আমি নাকি ধর্ম মানি না, যাতা খাই, যার-তার সঙ্গে মেলামেশা করি। অভিযােগগুলাে যে। মিথ্যে, তা নয়। যে ঘরের কোণের ছােট্ট প্রদীপের আলােয় অদৃষ্টের খেয়াঘাট খুঁজে পায়নি, তাকে তাে আকাশভরা সূর্য, তারার আলােয় পথ চিনতে হবেই। জীবনের টানে, জীবিকার গরজে কক্ষচ্যুত উল্কার মতাে ঘুরেছি এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরােপ-আমেরিকা, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-নগর। যারা ভালবেসে কাছে টেনেছে, তাঁদের কাছেই আসন বিছিয়ে বসেছি; লেনদেন হয়েছে হাসি-কান্না-স্নেহ-প্রেম ভালবাসার। হঠাৎ একদিন ওদের কথাই লিখতে শুরু করলাম গল্প-উপন্যাসে। ভালবাসার কাঙাল আমি। পাঠক-পাঠিকাদের ভালবাসায় ভরে গেলাম। বাংলাদেশ-এর অগণিত পাঠক-পাঠিকাও অকৃপণ ঔদার্যে আমাকে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর করেছেন এবং তাঁদের জন্যই এই সংস্করণ সশ্রদ্ধ সবিনীত চিত্তে নিবেদন করছি।
বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি নিবাস তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমান জেলা) শালিখা থানার অন্তর্গত শরশুনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রোডের বাসায় বসবাস করতেন তিনি। শিক্ষাজীবন: নির্মম অদৃষ্ট সাড়ে তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। পিতার সীমিত আয়ে অকল্পনীয় দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে ভর্তি হলেন কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে। কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশুনা করার পর যশোরে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শেণীতে ভর্তি হন এবং নবম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বাবুও এক সময় সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও পরবর্তীতে শিক্ষক ছিলেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান এবং পুনরায় কলকাতায় রিপন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে আই. এ পাশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ সালে তিনি বি. এ পাশ করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রথম অবস্থায় সেখানেও তিনি ভাগ্যের বিড়ম্বনার স্বীকার হন। নিমাই ভট্টাচার্যের সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবনচর্চার একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যামোদীদের নিকট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তীকালে ‘রাজধানী নৈপথ্য’ রিপোর্টার. ভি. আই. পি এবং পার্লামেন্ট স্টীট নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিমাই ভট্টাচার্য পূর্ণোদ্যমে আরো আরো উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ‘মেমসাহেব’, ‘ডিপেস্নাম্যাট’, ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’, ‘ব্যাচেলার’, ‘ইমনক্যলাণ’, ‘ডিফেন্স’, ‘কলোনী’, ‘প্রবেশ নিষেধ’, ‘কেরানী’, ‘ভায়া ডালহৌসী’, ‘হকার্স কর্নার’, ‘রাজধানী এক্সপ্রেস’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘নাচনী’, ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’, ‘ডার্লিং’, ‘ম্যাডাম’, ‘ওয়ান আপ-টু-ডাউন’, ‘গোধুলিয়া’, ‘প্রিয়বরেষু’, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘মোগল সরাই জংশন’, ‘ইওর অনার’, ‘ককটেল’, ‘অনুরোধের আসর’, ‘যৌবন নিকুঞ্জে’, ‘শেষ পরানির কড়ি’, ‘হরেকৃষ্ণ জুয়েলার্স’, ‘পথের শেষে’ প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযোগ্য। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাসগুলোতে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে।