ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম লোকসাহিত্যের প্রতি বাঙালির দৃষ্টি কাড়েন। পরে সাধক হয়ে ‘মৈমনসিংহ ও পূর্ব বঙ্গ গীতিকা’ সংকলিত করেন শ্রীদীনেরশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর বিএ, ডি-এল। জাতীয় সত্তার বিকাশ সাধনে লোকসাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা রেঁনেসা যুগেই সর্বজন স্বীকৃত আমাদের আছে পল্লীগাথার অজস্র অথকতা। এর ভাষা লোকজ। ছন্দ যেন শিশুর আধো আধো কথকতা। আবার ভাব জগতের বিবেচনায় এর মাদকতায় ডুবেছেন দেশ ছাড়িযেও য্যুারোপের বহু পণ্ডিত। তাদের বিচারে বঙ্গসাহিত্যে এগুলো উঁচুমানের গাথাভাণ্ডার। ঐতিহাসিকতায় এবং কল্পনার শোভায় অপূর্বও বটে পালাগানের ভাষায় এর রূপ বুঝি “পুন্নমাসী চাঁদ যেমন দেখায় নদীর তলা”। ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য় সংগৃহীত তেমনি এক বিচিত্র আখ্যানভাগ ‘নেজাম ডাকাইতের পালা।’জানতে পারি, ওচল পাহাড়ের আড়ে ছিল এক ডাকু। মানুষের রক্তে তার নেশা। খুন করেছে মোট নব্বাই জনকে।অবশেষে কামেল ফকির শেখ ফরিদদের উদয়ে ভাবান্তর জাগে তার। পরে ডাকুকে বসতে হয় বারো বছরের ধ্যানে। সামনে শেখ ফরিদের রেখে দেওয়া লাঠি। কথিত আছে, সাধনা পূর্ণ হলে তারিই মাথা ফুঁড়ে এক অপরূপ লতা বেরুবে। অথচ ছয় বছরের মাথায় তার চোখ যায়। অধূরের কবরস্থানে। সেখানে উজিরপুত্র দুষ্ট জব্বর কবর খুড়ে লাল বাইয়ের লাশ তুলছিল। অমনি সে ছুটে মাথায় আঘাত হানতেই অপরাধী নিহত হয়। তাজ্জব! মুহূর্তেই লাঠির মাথা ফুঁড়ে বেরায় অপরূপ লতা! এভাবেই ‘নেজাম ডাকাইতের পালা’য় ফুটে ওঠে মানব বদলের কাহিনী। পরে এই ডাকুই রেনজাম পীর হিসেবে খ্যাত হন ইতিহাসের পাতায়।
কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সত্তর দশকে তার ‘টুকা কাহিনী’ নামক গল্পটি প্রকাশ পাওয়ার পর সবার দৃষ্টি পড়েছিল এই নতুন লেখকের দিকে। শুরুতেই প্রতিশ্র“ত নয়, পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হন। নগরের নানা রেখা-উপরেখা ছুঁয়ে গেলেও গ্রামীণ অভিজ্ঞতায় তার প্রধান অবলম্বন খোলা চোখে প্রবহমান জীবন দেখা। সেই জীবনের ভেতর দিয়ে বুলবুল চৌধরী ঢুকে পড়েছেন মানুষের অন্দর মহলে। প্রাণস্পর্শী দরদ দিয়ে তাদের তিনি বিন্যস্ত করেছেন সাহিত্যে। কথাসাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কহকামিনী’ নামে উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার। ২০১১ সালে কথাসাহিত্যের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ২০১৩ সালে ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’ নামক উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। তাঁর প্রকাশিত ছোট গল্পগ্রন্থগুলো হলো ‘টুকা কাহিনী’, ‘পরমানুষ’, ‘মাছের রাত’ ও ‘চৈতার বউ গো’। উপন্যাস ‘অপরূপ বিল ঝিল নদী’, ‘কহকামিনী’, ‘তিয়াসের লেখন’, ‘অচিনে আঁচড়ি’, ‘মরম বাখানি’, ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’, ‘ইতু বৌদির ঘর’ এবং ‘দখিনা বাও’। আত্মজৈবনিক দুটি হল ‘আঁকিবুঁকি’ ও ‘অতলের কথকথা’। তাছাড়া ‘গাঁওগেরামের গল্পগাথা’, ‘নেজাম ডাকাতের পালা’, ‘ভালো ভূত আর প্রাচীনগীতিকার গল্প’ নামক কিশোর গ্রন্থের রচয়িতাও তিনি। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।