ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা বাঙালির সাংগঠনিক প্রতিভা কেন কম? কেন বাঙালির সংগঠন টেকে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন এমন একজন বাঙালি, যিনি নিজে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য-উদাহরণ, সংগঠন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-গড়ে তুলেছেন, টিকিয়ে রেখেছেন বিকাশমান। কিন্তু এ-গ্রন্থ তাঁর সংগঠন গড়ে তোলার অভিজ্ঞতার বয়ান নয়, এ হচ্ছে একজন অভিজ্ঞ ও প্রশ্নশীল, মননশীল, প্রাজ্ঞ মানুষের নিজের ভেতরে জেগে ওঠা সওয়ালের জবাব ঢুঁড়ে ফেরা, ইতিহাসের মধ্যে, সাহিত্যের মধ্যে, সমাজের মধ্যে এবং নিজের জীবন ও নিজের চারপাশের মধ্যে। মৌলিকভাবেই এ-প্রশ্ন তিনি তুলেছেন, এবং মৌলিকভাবেই এ-প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করে গেছেন, ফলে আমরা লাভ করেছি একটা প্রায়-দার্শনিক গ্রন্থ। বেদনা, ভালোবাসা আর প্রজ্ঞার সঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লক্ষ করেছেন, বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণ তার আত্মপরতা, অসহায়তা, আত্মঘাত আর ঊনস্বাস্থ। তিনি খূঁজেছেন এই কারণগুলোর বিদ্যমানতার কারণ। লক্ষ করেছেন আমাদের ইতিহাস সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তি কীভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে। চিন্তা আর ভাব, প্রশ্ন আর প্রেম, যক্তি আর শিল্পের সমাহারের অপূর্ব নিদর্শন এই গ্রন্থ, একই সঙ্গে চিন্তা উদ্রেককারী, মনোহর ও প্রসাদগুণময়। আনিসুল হক
ভূমিকা বাঙালির ইতিহাস এক দীর্ঘ পরাধীনতার ইতিহাস। কেবল দীর্ঘ নয় প্রায় বিধিলিপির মতো নিস্কৃতিহীন এ-পরাধীনতা। ইতিহাসের কোনো পর্বে আমাদের স্বশাসনের নজির নেই। কখনো এদেশে চলেছে পালদের শাসন, কখনো সেনদের, কখনো পাঠানদের, কখনো মোগলদের, কখনো ব্রিটিশদের, কখনো পাকিস্তানিদের। সব যুগেই অন্যেরা এই দেশকে অধিকার করেছে, ভোগদখল ও লুটপাট করেছে। তারাই ছিল আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। নিজেদের ভাগ্য কখনোই আমরা নিজেরা নির্ধারণ করার সুযোগ পাইনি। পাইনি বলে আমাদের জাতির মৌলিক সংগঠনগুলোও গড়ে উঠতে পারেনি। হয় আমাদের জাতির দরকারি সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই দুর্বল ছিল বলে আমরা বহিরাগতদের পদানত হয়ে পড়েছিলাম নয়তো একবার পদানত হয়ে পড়েছিলাম বলে ঐ সংগঠনগুলো আর গড়ে ওঠেনি। একটা জাতির সংগঠনগুলো যত শক্তিশালী, সেই জাতি তত শক্তিশালী। আমাদের জাতির সংগঠনের জগৎটা খুবই দুর্বল। এটাই জাতি হিশেবে আমাদের দুর্বলতার মূল কারণ। জাতিগতভাবে সমর্থ হয়ে উঠতে হলে এই দুর্বলতা আমাদের কাটিয়ে উঠতেই হবে। ১৯৭১ সালে ঘটেছে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা : স্বাধীনতা। এই প্ৰথমবারের মতো নিজেদের ভাগ্য নির্মাণের অধিকার আমরা নিজেরা পেয়েছি। অজস্র দক্ষ সংগঠন গড়ে তোলার ভেতর দিয়ে জাতীয় ভাগ্যকে আজ আমাদের সুদৃঢ় করতে হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে পরাধীন থাকার ফলে আমাদের জীবনের মধ্যে এমন কিছু দুর্বলতা, অক্ষমতা, সংকীর্ণতা ও আত্মসর্বস্বতা জেকে বসে গেছে যে তা দিয়ে সুযোগ্য সংগঠন গড়ে তোলা,-অস্তিত্বের ও বিকাশের বড় আয়োজনে এগিয়ে যাওয়া-আমাদের পক্ষে সহজ হচ্ছে না। আমাদের জাতির অধিকাংশ মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতার অভাবও একে আরও প্রকট করে তুলেছে। ফলে ছোট বড় সংগঠন থেকে আরম্ভ করে আমাদের রাষ্ট্ৰীয় সংগঠনও আজ পর্যন্ত নানারকম অব্যবস্থা আর নৈরাজ্যের শিকার। কী কী কারণে আমরা সংগঠন গড়ে তুলতে পারছি না, এর ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, ভৌগোলিক ও শারীরিক কারণগুলো কী কী-এসব বিষয় আমি যা শাদা চোখে দেখে বুঝেছি, তা এই বইয়ে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। গত তিন দশকে স্বাধীনতার মুক্ত ও বাধাবন্ধনহীন পরিবেশে আমাদের দেশে যে হাজার হাজার সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করেছে সেগুলোকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য নিজেদের শক্তির পাশাপাশি আমাদের দুর্বলতাগুলোও আজ চিনে নেওয়া আমাদের জন্যে জরুরি। তা হলেই কেবল আমরা অক্ষমতার উষরতা এড়িয়ে অসংখ্য শক্তিশালী সংগঠনের ভেতর দিয়ে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ও জাতিকে গড়ে তুলতে পারব। আমি এ-বইয়ে আমাদের সেই দুর্বলতাগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি। কী করে সেগুলোকে অতিক্রম করা যায় তা ভাবার চেষ্টা করেছি। সংগঠন আমাদের জীবনে একটা নতুন জিনিশ। এ নিয়ে তাই আজ ব্যাপক ও শ্রমসাধ্যভাবে এ-জাতিকে ভাবতে হবে। খুবই অস্কুট, অসম্পূর্ণ ও অযোগ্যভাবে আমি, হয়তো প্ৰথমবারের মতো এই ছোট্ট বইটির মাধ্যমে। এ-ব্যাপারে কিছুটা ভাবনা তুলে ধরলাম। আশা করি। অচিরেই আমার চেয়ে উন্নত মেধা ও মননসমৃদ্ধ মানুষেরা তাঁদের জ্ঞান আর অন্তদৃষ্টি দিয়ে এই বিষয়টিকে আরও আলোকিত করতে এগিয়ে আসবেন। থেকে এই বইটি প্রকাশে এগিয়ে এসেছে। সেজন্যে তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সে আমার ছাত্র। কাজেই ভালোভাবেই সে গুরুদক্ষিণা দিয়েছে বলে ধরতে হবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলাউদ্দিন সরকারের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। তার অতন্দ্র সহযোগিতা ছাড়া বইটি প্রকাশ করা কঠিন হত ।
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হল। বইটিকে পাঠকেরা যতটা প্ৰত্যাখ্যান করবেন বলে আশঙ্কা করেছিলাম ততটা প্ৰত্যাখ্যাত হয়নি। অনেকে বইটি সামগ্রিক পছন্দ করেছেন। অনেকে অনেক বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছেন। বইটিকে নতুন করে লেখার ইচ্ছা! ছিল। বরাবরের মতো সময়ের অভাবে তা সম্ভব হল না। সামান্য পরিমার্জনা করেই এবারের মতো দায় শোধ করলাম ।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকা ৩০ ডিসেম্বর ২০০২
ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা *বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতা *বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণ আত্মপরতা *বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার আরও কারণ : ব্যক্তিগত অসহয়তা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা ও আত্মঘাত *সাংগঠনিক ব্যর্থতার মৌলিক কারণ : স্বাস্থ্যগত দুর্বলতা! *কেন আমাদের স্বাস্থ্য বা কর্মদক্ষতা নিচুমানের? *আমাদের সরকার-পদ্ধিতির রূপরেখা *সংসদীয় বনাম রাষ্ট্রপতিপদ্ধরি গণতন্ত্র *আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর রূপরেখা *সংগঠনের উত্তরাধিকার
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।