ভূমিকা এই সংস্করণে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থটি যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, সেটিই আমার মূল রচনা। এই গ্রন্থটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন দুর্ভাগ্যবশত মূল পাণ্ডুলিপিটিকে সংক্ষিপ্ত করে চারশতও কম পৃষ্ঠায় দাঁড় করানো হয় এবং তাতে ছবি ছিল না এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অধিকাংশ শ্লোকেরই কোন ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়নি। শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীঈশোপনিষদ আদি আমার অন্যান্য সমস্ত গ্রন্থে মূল শ্লোক, তার ইংরেজী বর্ণান্তর, প্রতিটি সংস্কৃত শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ, শ্লোকটির অনুবাদ ও তাৎপর্য দেওয়ার রীতি আছে। তার ফলে গ্রন্থগুলি খুব প্রামাণিক ও পণ্ডিতসুলভ হয় এবং তার অর্থ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। তাই, আমার মূল পাণ্ডুলিপিটিকে যখন সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছিল, তখন আমি খুব একটা খুশি হতে পারিনি। কিন্তু পরে, যখন ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থের চাহিদা বেশ বাড়তে লাগল, তখন অনেক পণ্ডিত ও ভক্ত এই গ্রন্থটি পূর্ণ আকারে প্রকাশ করবার জন্য আমাকে অনুরোধ করতে লাগলেন এবং মেসার্স ম্যাকমিলান এন্ড কোম্পানিও পূর্ণ আকারে গ্রন্থটি প্রকাশ করতে সম্মত হলেন। তাই গুরু-পরম্পরাক্রমে লব্ধ ভগবদ্গীতার পূর্ণজ্ঞান ও যথার্থ ব্যাখ্যা সহ দিব্যজ্ঞান সমন্বিত এই মহৎ গ্রন্থটির মূল পাণ্ডুলিপিকে প্রকাশ করতে চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে আরও সুষ্ঠু ও ব্যাপকভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন একটি অকৃত্রিম, ঐতিহাসিক প্রমাণসিদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত ও অপ্রাকৃত আন্দোলন, কারণ তা যথার্থ ভাগবদ্গীতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই আন্দোলনটি ধীরে ধীরে সমস্ত পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে, বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের কাছে। প্রবীণ লোকদের কাছেও এটি ধীরে ধীরে চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে। তাঁরা এর প্রতি এমনভাবে আকৃষ্ট হচ্ছেন যে, আমার অনেক শিষ্যের বাবা এবং ঠাকুরদারাও আমাদের এই মহৎ সংস্থাটির- আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের আজীবন সদস্য হয়ে তাঁদের সহানুভূতি জানাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে, আমি যে আমেরিকায় কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন শুরু করেছি, তা আমেরিকাবাসীদের পক্ষে অত্যন্ত কল্যাণকর। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলনের পিতা হচ্ছেন, শ্রীকৃষ্ণ নিজেই, কারণ বহুদিন পূর্বে তিনিই এই আন্দোলনটি শুরু করেন, কিন্তু গুরু-পরম্পরার ধারায় আজকের মানুষের কাছে তা সুলভ হয়ে নেমে এসেছে। এই সম্পর্কে যদি আমার কোন কৃতিত্ব থেকে থাকে, তবে সেই আমার ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নয়, তা আমার পরমারাধ্য গুরুদের ও বিষ্ণপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য অষ্টোত্তরশত শ্রীমদ্ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদের কৃতিত্ব।
এই বিষয়ে আমার যদি কোন কৃতিত্ব থেকে থাকে, তবে সেটি শুধু এই জন্যই যে, ভগবদ্গীতাকে আমি অবিকৃতভাবে নিবেদন করবার চেষ্টা করেছি। আমার এই ভগবদ্গীতা যথাযথ নিবেদন করার আগে ভগবদ্গীতার যতগুলি অনুবাদ হয়েছে, তার প্রায় সব কয়টি সংস্করণই গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করবার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ প্রকাশ করতে আমাদের এই যে প্রচেষ্টা, সেটি কেবল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করা। জড়বাদী মনোধর্মী, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিকদের মতবাদ প্রচার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারণ, অন্যান্য বিষয়ে তাঁদের যথেষ্ট পাণ্ডিত্য থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে তাঁদের জ্ঞান অত্যন্ত অল্প। শ্রীকৃষ্ণ যখন বলেন, মম্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু আদি, তখন তথাকথিত অন্যান্য সমস্ত পণ্ডিতদের মতো আমরা বলি না যে, শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর অন্তরাত্মা এক নয়। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছে পরম এবং তাঁর নাম, রূপ, গুণ, লীলা আদি সবই অভিন্ন। গুরু-পরম্পরাসুত্রে কৃষ্ণভক্ত না হতে পারলে, শ্রীকৃষ্ণের এই পরম পদটি উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ তথাকথিত সমস্ত পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও স্বামীরা শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে কোন জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও যখন ভগবদ্গীতার ভাষ্য রচনা করে, তখন তারা শ্রীকৃষ্ণকে নির্বাসিত করতে চায় বা হত্যা করতে চায়। ভগবদ্গীতার উপর এই ধরনের অপ্রামাণিত ভাষ্যগুলিকে বলা হয় মায়াবাদী ভাষ্য এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের ঐ সমস্ত পাষণ্ডীগুলির সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, “মায়াবাদি-ভাষ্য শুনিলে হয় সর্বনাশ।” তিনি স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে, কেউ যদি মায়াবাদীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভগবদ্গীতা বুঝতে চেষ্টা করে, তা হলে তার নর্বনাশ হবে। এই সর্বনাশের ফল হচ্ছে যে, ভগবদ্গীতার ভান্ত পাঠক অবশ্যই পারমার্থিক জীবনে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে এবং ভগবানের কাছে ফিরে যেতে অক্ষম হবে।
যে উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য ব্রহ্মার প্রতিদিনে একবার, অর্থাৎ প্রতি ৮৬০,০০,০০,০০০ বৎসরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পৃথিবীতে অবতরণ করেন, সেই উদ্দেশ্যকে অনুপ্রাণিত করে বদ্ধ জীবদের পথপ্রদর্শন করবার জন্যই এই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ প্রকাশিত হয়েছে। ভগবানের সেই উদ্দেশ্যের কথা ভগবদ্গীতায় বর্ণিত হয়েছে এবং তা আমাদের যথাযথভাবে গ্রহণ করতে হবে; তা না হলে ভগবদ্গীতা ও তাঁর বক্তা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানবার চেষ্টা করা বৃথা। ভগবদ্গীতায় ভগবান নিজেই বলেছেন যে, লক্ষ কোটি বৎসর আগে তিনি সূর্যদেবকে সর্বপ্রথম এই জ্ঞান দান করেন। এই সত্য আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে এবং এভাবেই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশের কদর্থ না করে, ভগবদ্গীতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছার কথা উল্লেখ না করে ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যা করা সবচেয়ে গর্বিত অপরাধ। এই অপরাধ থেকে রক্ষা পেতে হলে, শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে জানতে হবে, ঠিক যেভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রথম শিষ্য অর্জুন তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে জেনে ছিলেন। ভগবদ্গীতাকে এভাবে উপলব্ধি করা যথার্থই লাভজনক এবং মানব-জীবনের উদ্দেশ্য পরিপূরণে সমাজের যথার্থ কল্যাণ সাধনের জন্য অনুমোদিত।
কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন মানব-সমাজের পক্ষে অপরিহার্য, যেহেতু তা জীবনের সর্বোচ্চ পূর্ণতা প্রদান করে। সেটি কিভাবে সম্ভব তা সম্পূর্ণভাবে ভগবদ্গীতায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত জড়াসক্ত তার্কিকেরা ভগবদ্গীতার অজুহাত দেখিয়ে তাদের আসুরিক প্রবৃত্তিগুলি চরিতার্থ করবার চেষ্টা করছে এবং মানুষকে বিপথে চালিত করছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের সহজ সরল উদ্দেশ্যটি উপলব্ধি করতে পারছে না। সকলেরই উচিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা, এবং প্রতিটি জীবের স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হওয়া। প্রত্যেকেরই জানা উচিত যে, প্রতিটি জীব হচ্ছে ভগবানের নিত্য সেবক এবং শ্রীকৃষ্ণের সেবা না করলে তাকে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মায়ার সেবা করতে হবে এবং তার ফলে জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে নিত্যকাল আবর্তিত হতে হবে; এমন কি তথাকথিত মুক্ত মনোধর্মী মায়াবাদীদেরও এই প্রচণ্ড দুঃখের হাত থেকে নিস্তার নেই। ভগবদ্গীতার জ্ঞান হচ্ছে একটি মহৎ বিজ্ঞান এবং নিজের যথার্থ কল্যাণ সাধন করার জন্য এই জ্ঞান আহরণ করা প্রতিটি জীবের পরম কর্তব্য।
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে এই কলিযুগে, শ্রীকৃষ্ণের বহিরঙ্গা প্রকৃতির দ্বারা মোহিত। বিভ্রান্ত হয়ে তারা মনে করে যে, জড় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উন্নতি সাধন করার ফলেই প্রতিটি মানুষ সুখী হতে পারবে। তারা জানে না, এই জড়া প্রকৃতি বা ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি অত্যন্ত প্রবল, যেহেতু প্রতিটি জীবই জড়া প্রকৃতির কঠিন নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ। ভগবানের বিভিন্ন অংশ হওয়ার ফলে জীব আনন্দময় এবং তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে ভগবানের সেবা করা। মায়ার দ্বারা মোহিত হয়ে জীব বিভিন্নভাবে তার ইন্দ্রয়ের তৃপ্তিসাধন করার মাধ্যমে সুখী হবার ভ্রান্ত চেষ্টা করে, কিন্তু সেভাবে সে কোনদিনই সুখী হতে পারে না। আত্মোন্দ্রিয়-প্রীতি সাধনের পরিবর্তে কৃষ্ণের ইন্দ্রয়ের তৃপ্তিসাধন করাটাই হচ্ছে তার কর্তব্য। সেটিই হচ্ছে জীবনের চরম সার্থকতা। ভগবান সেটিই চান এবং তিনি তা দাবি করেন। ভগবদ্গীতার এই মূল ভাবটি উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন সমস্ত জগৎ জুড়ে ভগবদ্গীতার এই মূল ভাবটি শিক্ষা দিচ্ছে, এবং আমরা যেহেতু ভগবদ্গীতা যথাযথের মূল ভাবটির কদর্থ করছি না, তাই যে সমস্ত মানুষ ভগবদ্গীতা অধ্যায়ন করে ঐকান্তিকভাবে উপকৃত হতে চান, ভগবানের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ভগবদ্গীতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার জন্য তাদের অবশ্যই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। তাই আমরা আশা করি যে, এই ভগবদ্গীতা যথাযথ পাঠ করে মানুষ পরম লাভবান হবে এবং যদি একজন মানুষও ভগবানের শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হতে পারে, তা হলে আমাদের এই প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করব।
এ. সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী ১২মে, ১৯৭১ সিডনি, অস্ট্রেলিয়া