“উপন্যাস সমগ্র " বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ এক দুরূহ, ব্যতিক্রমী গদ্যশৈলীর প্রাচীর তুলে পাঠকের অস্তিত্বকে কমলকুমার মজুমদার একদা যেন বিপন্ন করে তুলেছিলেন। অথচ তাঁর কথাসাহিত্যের অন্তলোক প্রথমাবধি জীবনমায়ার সৃজনে ও রহস্যে ভরপুর। জীবনের সংজ্ঞা, বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা এক অপার তাৎপর্যে মণ্ডিত করে তাঁর উপন্যাস-গল্পে তিনি ছড়িয়ে। দিয়েছিলেন। সান্ধ্যভাষার মতাে এক দুস্তর গদ্যচর্চায় তিনি অকম্পিত। অথচ প্রকরণগত দুরূহতার আবরণ সরিয়ে, কমলকুমারের সৃষ্টির জগতে প্রবেশের পর, পাঠক ক্রমশ আবিষ্কার করেন এই লেখকের অনন্যতা। পাঠক অনুভব করেন, মানুষের সংকট ও সমস্যা নিয়ে তিনি যে-শিল্পভুবন সৃষ্টি করেছেন, তার ব্যঞ্জনা আবহমান কালের। কমলকুমারের উপন্যাসের পটভূমি বহুরঙে বর্ণাঢ্য। বর্ণনার অনুপুঙ্খতায় তিনি সনিষ্ঠ। তাঁর সীমিত সংখ্যক ও মিতায়তন উপাখ্যানমালায় হয়তাে বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা কম, কিন্তু গভীরতায় সেগুলি অসাধারণ। প্রত্যেকটি কাহিনীতে তিনি চিত্রিত করেছেন নিগুঢ় অনুভূতি ও মননপ্রবাহকে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্ৰসমূহ জীবনমুখী। জীবনবিমুখ নয়। তারা একই সঙ্গে জৈববৃত্তিতে ভরপুর বাইরের মানুষ, আবার মরমী অস্তিত্বে চিরন্তন ভেতরের মানুষ। কমলকুমারের স্বসৃষ্ট গদ্যভাষা বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে একেবারেই স্বতন্ত্র। তাঁর ভাষা যেন এক অদ্বিতীয় লেখকসত্তার বাণীবাহক। বর্মাচ্ছাদিত এই ভাষা গীতময়, পাশাপাশি চিত্ররূপময়। হয়তাে গীতিময়তার চেয়ে ভাস্কর্যধর্মিতা তাতে বেশি। কল্পচিত্র, শব্দচিত্র ও উপমাচিত্র নির্মাণে তিনি প্রায়শই অননুকরণীয় স্রষ্টা। এ ভাষা অনবদ্য এক আশ্চর্য মিনার। চলিত বাংলাতেও কমলকুমার বিপীরতযাত্রার স্বাক্ষর রেখেছেন। কখনও জটিলতম বাক্যবন্ধে আকীর্ণ, কখনও বা পূর্ণচ্ছেদহীন অথচ গুঢ়ার্থবাহী এই গদ্যশৈলী কমলকুমার সচেতনভাবেই তাঁর উপন্যাসের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুভবে, একটি ছােট অথচ মনােযােগী পাঠকগােষ্ঠী তৈরি করবেন বলেই যেন কমলকুমার তাঁর কাহিনীগুলিতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরও সুদৃঢ় করেছেন।তাঁর এই চেষ্টাকৃত আয়ােজন সত্ত্বেও, কমলকুমার বাংলা সাহিত্যে এক স্বাতচিহ্নিত কথাশিল্পী। কথাসাহিত্যের মূল্যমানের আলােচনায় ও বিচারে তাঁর উপন্যাসসমূহকে তাই বাদ দেওয়া যাবে না। বরং সাহিত্যের এক প্রবাদপুরুষরূপে তিনি স্মরিত ও পঠিত হবেন। তাঁর এই উপন্যাস সমগ্রে গৃহীত হয়েছে অন্তর্জলী যাত্রা, গােলাপ সুন্দরী, অনিলা স্মরণে, শ্যাম-নৌকা, সুহাসিনীর পমেটম, পিঞ্জরে বসিয়া শুক, খেলার প্রতিভা এবং শবরীমঙ্গল। সঙ্গে বিস্তৃত গ্রন্থপরিচয় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা।
কমলকুমার মজুমদার (জন্ম : ১৭ নভেম্বর, ১৯১৪ - মৃত্যু : ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯) বিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক যিনি আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিগণিত। তাকে বলা হয় 'লেখকদের লেখক'। তার উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা এর অনন্যপূর্ব আখ্যানভাগ ও ভাষাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস ইয়োরোপীয় উপন্যাসের আদলে গড়ে উঠেছে, কমলকুমার মজুমদার সেই অনুসরণতা পরিহার করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুরূহতম লেখকদের একজন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন; যেমন সুহাসিনীর পমেটম উপন্যাসে ২৫০ পৃষ্ঠায় যতি-চিহ্ন বিহীন মাত্র একটি বাক্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের দুর্বোধ্যতম লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। দীক্ষিত পাঠকের কাছে কমলকুমার অবশ্যপাঠ্য লেখক হিসেবেই সমাদৃত হলেও অদ্যাবধি তিনি সাধারণ্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন নি।