"অমৃত বিষের পাত্রে" বইটির কিছু অংশঃ প্রতিজ্ঞা ছিল যে মনে, যাবো নির্বাসনে। অরণ্যে না। বনের গভীরে নিবিড়ে, ছায়াঘন অন্ধকারে, ঝিঝি ডাকা নিঝম প্রহরে না। যেখানে কোন আড়ালে থেকে, পাহাড়ী ঝরনা কুলকুল, বহে, বাজে কোন এক অপ্রাকৃত অনাদিকালের দুর্বোধ্য গানের সুরে, নির্বাসনে যাবো না সেখানে। নির্বাসন কি কেবল বনবাসেই হয়। অথবা নির্জন পাহাড়ে। কিংবা সমুদ্রের ছায়াহীন দর বালুচরে। নির্বাসন যদি অনিবার্য হয়, সে কি পটলডাঙার অন্ধ গলির বদ্ধ ঘরে সম্ভব না? অথবা শ্যাওলা ধরা, ঘিঞ্জি বাড়ি ঠাসা চাঁপাতলা ফাস্ট বাই-লেনে ? নির্বাসন তো মনে মনেও সম্ভব। মন নিয়ে যাও বনে। মন চালান দাও পাহাড়ে সমুদ্রে যে কোনো নির্জনে। মনকে বলো, মন চলো যাই নির্বাসনে। সব ছেড়ে, সমাজ সংসার বন্ধ যতো ভালো-লাগা ভালবাসা, নিবিড় করে নিয়ে থাকা, আকাংখা ইচ্ছায় উদ্বেল পাওয়া না-পাওয়া, সব কিছু ছেড়ে মন নিবাসনে থাকো। বধির হও, অন্ধ থাকো, অনুভূতিকে রাখো মুড়ে জড়ত্বের কাঁথায়। যা শোনবার জন্য শ্রবণ উন্মুখ, তা শুনি না। যা দেখবার জন্য চোখ ব্যাকুল, তা দেখি না। অনুভবের নাম হোক অচল নগর। সেখানে হাসি কান্না সব খেলা বন্ধ কাজঅকাজের সব পাট চোকানো। এই হবে মনে মনে নির্বাসন জলে থেকেও জল ছোঁয়া নেই। চার দেওয়ালের চারিদিকেই অরণ্য পর্বত সমুদ্র। মাথার আচ্ছাদন আকাশ নিজন নির্বান্ধব, আমি বসে আছি একাকী। মাইকেল এঞ্জেলোর সেই চিত্রটি ভাসছে চোখের সামনে। একাকী নগ্ন পুরষে বসে আছে পাহাড়ের কোলে, নির্বাক গম্ভীর, গভীর দৃষ্টি বহ, দরে। কিন্তু সে কি নির্বাসিত না আমি নির্বাসিত। কালকট। নিবর্ণসিতের এই নাম ভালো। তীব্র বিষ, আমি গরল, আমি হলাহল। আমার সবই বিষে ভরা। আমার সারা জীবন কেবল, ‘হা অমত? করে ফেরা। এই যে নির্বাসনে যাওয়া, এই যাওয়াও -ই। নির্বাসন—অমতের তিয়াষায়। কিন্তু দেখছি, মন বে-বহাল। নিজের ওপরে তার ভরসা নেই। মন ভীর। মন চলো যাই নির্বাসনে, এ কথায় বুকে জোর মিলছে না। জলে থেকেও জল না ছোঁয়ার, সাধকের সেই শক্তি আমার নেই। চার দেওয়ালে দেখছি, অরণ্য পর্বত সমদ্রকে ঠেলে ফেলে দিয়ে, সমাজ সংসার লীলা করতে চাইছে। ওসব আলগা বেড়ার যুক্তি। ছে’দো কথার অটাসাঁটি। হলেও বা স্বেচ্ছা নির্বাসন, মনে মনে তা সম্ভব নয়। এমন কি পটলভাঙা, চাঁপাতলা ফার্স্ট বাই-লেনেও ভরসা নেই। মনে হচ্ছে, আমার নির্বাসনের সব বাঁধন চরমার করে, অন্ধ-গলি কলকলিয়ে গে'টা কলকাতা হয়ে উঠবে। যে-আমি, সে-ই আমি, আমার সকল কামনা বাসনায় 'ভেসে যাব। অতএব যাকে বলে গতর নাড়ানো তাই করতে হবে। দেশান্তরী হতে হবে। মনে মনে হবে না। দেশে আর ঘরে বসে হবে না। এটা চোরা মনের সিদ কাটা। নির্বাসনের ভয়ে ফাঁক খোঁজা। একটু আধটু চিনি তো। নিজেকে ধরার জন্যে, নিজেরই ফাঁদ পাতা। একে বলে মনের কুহক। এই কুহকে.......
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।