শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫৯ সালে । 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল ‘জল পড়ে পাতা নড়ে' । গৌরকিশোর ঘোষের প্রথম উপন্যাস, আর একইসঙ্গে তাঁর পরিকল্পিত এক মহান এপিক ট্রিলজিরও প্রথম খণ্ড । সেই ট্রিলজির দ্বিতীয় খণ্ড, বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত ‘প্রেম নেই । এই দুটি খণ্ডেরই বিষয় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, পটভূমি দু'ক্ষেত্রেই গ্রাম, চালচিত্রে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ছবি । এই ধারাবাহিকতারই মিলনমোহনা এই তৃতীয় ও শেষ খণ্ড, ‘প্রতিবেশী’ । বিষয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। পটভূমি, মানুষেরই মনোলোক । মানুষ যখন কেবলই সরে যাচ্ছে মানুষের কাছ থেকে, মানুষ যখন প্রকৃতির কাছ থেকে সরে যাচ্ছে, এমন-কি, সরে যাচ্ছে নিজের কাছ থেকেও, বিপর্যয়কর সেই বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ-উপন্যাস জানিয়ে দেয় ভালোবাসার কথা। ‘ভালোবাসো, ভালোবাসো, তোমার প্রতিবেশীকে তুমি ভালেবাসো' । মানুষের প্রতি বিশ্বাস- আর ভালোবাসা-ফেরানো উপন্যাস ‘প্রতিবেশী’ । বলা ভালো, ‘দেশ মাটি মানুষ' নামের এই মহান এপিক ট্রিলজিতে একই কাহিনীর ধারাবাহিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে চাননি লেখক । বরং চেয়েছেন, বিভিন্ন ঘটনাপরম্পরার মধ্য দিয়ে একই বিষয়ের ঐতিহাসিক পরিণতি তুলে ধরতে ; উপন্যাসের পাত্রপাত্রী জীবনের টানাপোড়েনে ফুটিয়ে তুলতে সাম্প্রতিক ইতিহাসেরই এক জীবন্ত নকশা । সেই নকশা বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের। এই ট্রিলজির সময়সীমা ১৯২২-৪৬। গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ এই পঁচিশ বছরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে, ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে সংঘাত ক্রমশ গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে পৌঁছে কীভাবে দেশকে করেছে খণ্ড-খণ্ড—একদিকে যেমন তারই অসামান্য চিত্রণ, অন্যদিকে, ভারত-ইতিহাসের ট্র্যাজেডির সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডির এক কুশলী মিশ্রণ এই তিন খণ্ড উপন্যাসে ।
গৌরকিশোর ঘোষ (২২ জুন, ১৯২৩ - ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০) একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তিনি রূপদর্শী ছদ্মনামে গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের যশোর জেলায় হাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক পড়াশোনা করেন শ্রীহট্ট জেলার এক চা-বাগানে। স্কুলের পাঠ নদিয়া জেলার নবদ্বীপে। ১৯৪৫ সালে আইএস-সি পাশ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত গৌরকিশোর ক্রমাগত পেশা বদলে গেছেন। প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, খালাসি, রেস্তরাঁয় বয়, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, ইস্কুল মাস্টার থেকে ভ্রাম্যমান নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার ইত্যাদি অসংখ্য কাজ করেছেন সাংবাদিক জীবনে প্রবেশের আগে পর্যন্ত। স্বাধীনচেতা সাংবাদিক গৌরকিশোর ১৯৭৫ সালের 'মিসা' (MISA) অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জন-নিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার হন। প্রেসিডেন্সি জেলে তাকে বন্দী রাখা হয়। সাংবাদিকদের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বহু নির্যাতন সহ্য করেও নিরন্তর সংগ্রামের ব্রতী ছিলেন। মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনার জন্যে বুদ্ধিজীবী মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। তার সাহিত্য বাঙলার বিদগ্ধ পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করতেন তিনি। দেশ পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আশির দশকে আজকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দেশ-মাটি-মানুষ ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড 'প্রেম নেই' গ্রামীন মুসলিম জীবন নিয়ে সুবিশাল রচনা। দেশ পত্রিকায় এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বের হয়। এছাড়া সাগিনা মাহাতো, জল পড়ে পাতা নড়ে, আনাকে বলতে দাও, আমরা যেখানে, লোকটা, রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য ইত্যাদি তার অন্যান্য গ্রন্থ। সাগিনা মাহাতো, তপন সিংহর পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। গৌরকিশোর সৃষ্ট মজলিশি চরিত্রের নাম ব্রজদা। সাংবাদিকতার জন্যে তিনি ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার 'কো জয় উক' স্মৃতি পুরষ্কার এবং ১৯৮১ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই বছর মহারাষ্ট্র সরকারের পুরষ্কার, ১৯৯৩ সালে হরদয়াল হারমোনি পুরষ্কার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরষ্কার পান। তিনি ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার ও ১৯৮২ তে বঙ্কিম পুরষ্কার পান। কলকাতা মেট্রো রেলের নতুন প্রস্তাবিত চিংড়িহাটা স্টেশনটি গৌরকিশোর ঘোষের স্মৃতিতে রাখা হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে মারা যান গৌরকিশোর ঘোষ।