বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে-কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ-ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্মের মধ্যে। চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান।" লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাব্য হিসাবে রামায়ণ যে মহাভারতের থেকে প্রাচীন একথা আমরা যেমন জানি, সেইসঙ্গে এও জানি যে, কাব্য হিসাবে রামায়ণের স্থান মহাভারতের উপরে। কিন্তু মহাভারতের মহিমা এতে বিন্দুমাত্র খর্ব হয় না। এ-দুই মহাকাব্যের নাম একত্রে উচ্চারিত হলেও দুটির উৎপত্তি ও প্রকৃতি যে স্বতন্ত্র, একথা জানতেন আমাদের প্রাজ্ঞ পূর্বপুরুষেরা। সেজন্যই তারা রামায়ণকে আখ্যাত করেছিলেন কাব্য’ রূপে, আর মহাভারতকে চিহ্নিত করেছিলেন পুরাণ-ইতিহাস' হিসেবে। রামায়ণে শুধু গার্হস্থ্য আশ্রমের মর্মবাণী ধ্বনিত আর মহাভারত মানবসভ্যতার সর্ববিধ আচার-অনুষ্ঠান ও চিন্তার আকর। এই মহাগ্রন্থে মানব-চরিত্রের যে জটিল রহস্য ও বৈচিত্র্য বিধৃত, ভারতীয় সাহিত্যে তার তুলনা পাওয়া যায় না। কথায় বলে, “যা নাই ভারতে, তা নাই ভারতে। অর্থাৎ মহাভারতের অন্তর্গত নয়এমন কিছুর অস্তিত্ব ভারতীয় চিন্তার মধ্যেও অলভ্য। পুরাকালে দেবতারা নাকি দাঁড়িপাল্লার একদিকে চাপিয়েছিলেন সরহস্য সমগ্র বেদ, অন্যদিকে মহাভারত। শেষােক্ত গ্রন্থের ওজন মহত্ত্ব ও গুরুত্বের দিক থেকে বেশি প্রমাণিত হওয়াতেই এ-গ্রন্থের নাম দেওয়া হয় 'মহাভারত'। মহাভারতের আলােচনামাত্রই অমৃতসমান। আর তার প্রসঙ্গ শ্রবণ- পুণ্যবানের কর্ম। অধ্যাপক সুখময় ভট্টাচার্য সেই পুণ্যপ্রসঙ্গেরই অবতারণা করেছেন তার এই দীর্ঘকাল দুষ্প্রাপ্য জনবৃত গ্রন্থে। মহাভারতের বহুধা বৈচিত্র্যমণ্ডিত অসংখ্য চরিত্রের বিশাল, বর্ণময় মিছিল থেকে তিনি বেছে নিয়েছেন, গুরুত্ব-অনুসারে পঞ্চাশটিরও বেশি চরিত্র। মূল মহাভারত অনুসরণ করে, প্রাসঙ্গিক শ্লোক উৎকলন করে তিনি শুনিয়েছেন এই চরিতাবলীর আনুপূর্ব জীবন-ইতিহাস। শেষােক্ত গ্রন্থের ওজন মহত্ত্ব ও দুর্বলতা প্রকৃতি ও স্বতন্ত্রতা। বিশ্লেষণ করেছেন দ্বন্দ্ব ও জটিলতার, সৌষম্য ও সীমাবদ্ধতার। অধ্যাপক সুখময় ভট্টাচার্যের পাণ্ডিত্য অগাধ, দৃষ্টি প্রখর, বক্তব্য ঋজু, এবং বর্ণনাভঙ্গি আশ্চর্যরকমের সর্বজনবােধ্য। এমন সর্বতােমুখী, পূর্ণাঙ্গ আলােচনা গ্রন্থ বিরল। এ যেন মহাভারতেরই এক নতুনতর, চিন্তা-উদ্দীপক ভাষ্য।