সুভাষচন্দ্রের ৮৬তম জন্মবার্ষিকীর শুভলগ্নে প্রকাশিত হচ্ছে সমগ্র রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ড। এ-খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হল, নেতাজীর প্রামাণ্য গ্রন্থ, ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’-এর অখণ্ড ও পরিমার্জিত সংস্করণ। এই প্রধান ও অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক রচনা পাঠকের স্বার্থে নতুন করে স্বচ্ছ ও সাবলীল বাংলায় অনুবাদ করানো হয়েছে। অনুবাদ করেছেন সুমন চট্টোপাধ্যায় ও সুগত বসু। নেতাজীর আত্মজীবনী ও প্রথম জীবনের চিঠিপত্র ও রচনার পরই এই গ্রন্থটি সকলের পড়া সমীচীন, এ-কথা মনে রেখে দ্বিতীয় খণ্ডে এই রচনাকে স্থান দেওয়া হল। ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’-এর প্রথম অংশ-১৯২০ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধের কাহিনী–গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে, লণ্ডনের এক প্রকাশন-সংস্থা থেকে। ইংলন্ডের নানান পত্র-পত্রিকায় উচ্চ প্রশংসিত এবং ইউরোপের বিদগ্ধ মহলে বিপুল সমাদৃত এই গ্রন্থটির ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশটি—১৯৩৫ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত মুক্তি-সংগ্রামের কাহিনী—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, ১৯৪২ সালে, সুভাষচন্দ্র বার্লিনে বসে লিখেছিলেন। যুদ্ধের পর তাঁর সহধর্মিণীর কাছ থেকে সেই পাণ্ডুলিপিটি পাওয়া যায়। লণ্ডন থেকে প্রকাশিত ১৯৩৫ সালের বইটির একটি পুনর্মুদ্রণ কলকাতায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে, দ্বিতীয় অংশ আলাদাভাবে পুস্তকাকারে বেরোয় চার বছর বাদে। নেতাজীর সমগ্র রচনাবলীতে ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম’-এর আদ্যন্ত পরিমার্জিত অখণ্ড সংস্করণের সন্নিবেশ তাই নানা দিক থেকে জরুরী একটি চাহিদাকেই মেটানো। এ-গ্রন্থ সম্পর্কে নানা পত্র-পত্রিকার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মুল্যবান মতামতও সেই সঙ্গে সংকলিত হয়েছে। এ-ছাড়াও দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্টে রয়েছে সুভাষচন্দ্রের একটি সাক্ষাৎকারের বিবরণ। এটিও কৌতুহলোদ্দীপক। মূল গ্রন্থে ফ্যাসিজম্ ও কম্যুনিজম সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্যের কিছু ব্যাখ্যা এই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবিপ্লবের প্রধান হোতা। তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতের ও নবজাগ্রত এশিয়ার ইতিহাস উপলব্ধি করা সম্ভবপর নয়। তাঁর অসামান্য জীবন জাতীয় আন্দোলনের অধ্যায় থেকে অধ্যায়ান্তরে বিস্তৃত। কর্মময় জীবনের বিভিন্ন অংশ পরিব্যাপ্ত দেশ থেকে দেশান্তরে। তিনি শুধ, আদর্শ নেতা বা বাগ্মী ছিলেন না, ছিলেন দার্শনিক, চিন্তানায়ক, শক্তিশালী লেখক। জীবনের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন দেশে বসে বিভিন্ন বিষয়ের উপর তাঁর অসংখ্য রচনা ও বাণী এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যা একত্র করে সমগ্র রচনাবলীর আকারে প্রকাশ করা- সন্দেহ নেই—একটি দুরূহ, গবেষণাসাপেক্ষ ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ। সেই কাজেই হাত দিয়েছেন আনন্দ পাবলিশার্স। সুভাষচন্দ্রের সমগ্র রচনাবলী সুসংবদ্ধভাবে খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তাঁরা। এ-কাজে তাঁদের সহায়তা করছেন নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো, বিগত কয়েক দশক ধরে নেতাজীর রচনা ও বাণীকে চিরন্তন করে রাখার কাজে যাঁদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাঁদের নিজস্ব সংগ্রহশালায় এমন বহু, দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য দলিল রয়েছে যার স্বত্ব একান্তভাবে তাঁদেরই। আনন্দ পাবলিশার্স-এর সমগ্র রচনাবলীকে সম্পূর্ণাঙ্গ করে তোলার কাজে সেইসব দলিল তাঁরা ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এর ফলে এমন বহু তথ্য, চিঠি, লেখা, ভাষণ, প্রতিলিপি, ছবি ও বিবৃতি এই রচনাবলীর অন্তর্গত করা সম্ভবপর হয়েছে এবং হচ্ছে যা অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা নেই। সমগ্র রচনাবলীর প্রথম খণ্ডটি এর মধ্যেই বিপুল সমাদৃত। সেই খণ্ডে সুপরিকল্পিত চারটি ভাগ। প্রথম ভাগে সুভাষচন্দ্রের অনন্য আত্মচরিত ‘ভারত পথিক’। দ্বিতীয় ভাগে সুভাষচন্দ্রের দুশো আটটি চাঞ্চল্যকর চিঠি। তৃতীয় ভাগে নতুন ভারতবর্ষ গড়ার কাছে আজকের যুবসম্প্রদায়কে প্রেরণা যোগাবার মতো আটটি প্রবন্ধ। চতুর্থ ভাগে সংযোজিত বংশধারা এবং এমন-কিছু, তথ্যভিত্তিক রচনা যেগুলি আত্মজীবনী, পত্রাবলী ও বিবিধ প্রবন্ধ—সংগ্রহের পরিপূরক।
কংগ্রেস দলের বামপন্থী নেতা, ফরওয়ার্ড ব্লক এর প্রতিষ্ঠাতা ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সর্বাধিনায়ক। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি এখনকার ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে সুভাষচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি অবশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুরের কাছে কোদালিয়া গ্রামে। ১৯১৯ সালে দর্শনে প্রথম শ্রেণিতে বিএ পাস করেন তিনি। এরপর বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ১৯২০ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসেন। এই পরীক্ষাতে চতুর্থ স্থান অধিকার করলেও, ১৯২১ সালে সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেন এবং দেশে ফিরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অধীনে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কলকাতা শহরের মেয়র হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে ইংরেজরা জেলে বন্দী করে। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষ। কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সেই পদ ত্যাগ করেন। এরপর জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গেও তাঁর মতবিরোধ হয়। তখন কংগ্রেসের মধ্যেই তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি রাজনৈতিক উপদল তৈরি করেন। এরপরই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গৃহবন্দী করে। ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বাড়ি থেকে অন্তর্হিত হন। এরপর দেশের বাইরে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সৈন্য ও রসদ সংগ্রহ শুরু করেন। প্রথমে জার্মানির সঙ্গে কথা বলেন। পরে জাপানের সক্রিয় সাহায্য আদায় করেন। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে রেডিও বার্লিন থেকে নিয়মিত বেতার সম্প্রচারও শুরু করে দেন সুভাষ। পরের বছর পূর্ব এশিয়ায় গিয়ে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। এই ফৌজে তিনিই হন সর্বাধিনায়ক। দেশবাসী তাঁকে ‘নেতাজি’ অর্থাৎ ‘মহান নেতা’ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৪২ সালের ২১ অক্টোবর নেতাজি ‘আর্জি-হুকুমৎ-এ-আজাদ হিন্দ’ বা ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ ঘোষণা করেন। এই সরকার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। জাপানি বাহিনীর সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত অভিযান চালায়। মণিপুরের কোহিমা দখল করে স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এই বাহিনী। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জও দখল করেছিলেন তাঁরা। নেতাজি এই দ্বীপের নাম রেখেছিলেন ‘শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ’। বলা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানের তাইপেইতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সত্যতা আজও প্রমাণিত হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সকল দেশবাসীকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক অখণ্ড জাতিসত্ত্বায় বেঁধে জাতীয় সংহতিকে দৃঢ় করেছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের জওয়ানদের মধ্যে তিনি ভালবাসা ও আনুগত্যের এক আশ্চর্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি দেশ স্বাধীন হলে সেদেশের প্রশাসন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কেমন হবে, তাও ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু তাঁর পরিবারবর্গের আপত্তিতে এই সম্মান দেওয়া হয়নি। তাকে সুভাষ চন্দ্র বোস ও বলা হয়।