ফ্ল্যাপে লিখা কথা সবাই সাহিত্য পড়ে না, কিন্তু সকলে সংগীত শোনে। তাই সংগীতকারের হৃদয়মথিত সংগীতের প্রধান গন্তব্য শ্রোতার প্রাণ। পারস্পরিক এই সম্পর্কের কারণেই সংগীতশিল্পী যেমন শ্রোতা সৃষ্টি করে, শ্রোতাও তেমনি অবদান রাখে সংগীতকারের নির্মাণে। এর একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ অমিয়নাথ সান্যাল। তাঁর অমর গ্রন্থ স্মৃতির অতলে পড়ে মনে হবে মহান গায়কের সমান মাপেরই মহান শ্রোতা তিনি। তাঁর মতো শ্রোতারাই সৃষ্টি করেছেন মৌজুদ্দিন-গহরজানের মতো কালজয়ী শিল্পীদের। সংগীত রালিত হয়েছে প্রধানত তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে- দরবার, সমঝদার আর সরকার। সমঝদারের পর্বটিকে দরবারি এবং সরকারি পর্ব-দুটির সন্ধিক্ষণিক পর্বও বলা চলে। দরবারের সমবেত সভাসদ সকলেই সংগীতের প্রস্তুত শ্রোতা ছিলেন না। সরকারের আমন্ত্রিত পারিষদ তো সাধারণত সংগীতের শ্রোতাই নন, পয়সা বা পার্টির হোতা। কিন্তু এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী তৃতীয় প্রতিষ্টানস্বরূপ সমঝদারের ঘরে আয়োজিত সংগীতাসরে আমন্ত্রকসহ সকল শ্রোতাই থাকতেন সংগীতগুণী। ফলে সেই আসরে শিল্পীর সৃজন চলতো শুদ্ধতম মেজাজে, যেজন্য সৃষ্ট সংগীত তুঙ্গ স্পর্শ করতো। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান গ্রন্থের ক্ষুদ্র পরিসরেও তুলনামূলকভাবে বেশি জায়গা নিয়েছে শ্রোতার কথা।
ভূমিকা এ বইটির বিশেষত্ব খুঁজতে চাইলে জোরের বা ঝোঁকের জায়গাগুলো দেখতে হবে। যেমন ‘শ্রোতার কৈফিয়ত’ আর ‘মৌলিক সংগীত ও যৌগিত সংগীত’ রচনা দুটির ঝোঁক হল সংগীত-বিশেষ নিয়ে তর্কের ওপর। তর্কের ধরনটি হল ‘শকিং টু অ্যাটেনশন’। অর্থাৎ বক্তব্য বিষয়টির জটিলতা ও গভীরতার প্রতি, শুধু ঝাঁকুনি নিয়ে নয়, আঘাত করে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা- যাতে তিনি বিশেষ সংগীত-বিচিন্তাটি ঝাঁকিদর্শন করেই প্রসঙ্গান্তরে চলে না যান।
তেমনি ‘সংগীতে তৃতীয় পক্ষ’ রচনাটির জোর হল তৃতীয় পক্ষ তথা ‘রূপকার’-এর ওপর। ‘কথাকার’ কথা রচনা করলেন, তাতেই সংগীত সৃষ্ট হল না। ‘সরকার’ সুর রচনা করলেন, তাতেও সংগীত সৃষ্ট হল না। কারণ সংগীত ক্রিয়াত্নক বা ক্রিয়াসিদ্ধ শিল্প। যখন রূপকার উল্লিখিত কথা ও সুর রূপায়ণ করলেন, তখনই সংগীত সৃষ্ট হল। কারণ সংগীত রূপায়ণাপেক্ষ শিল্প বা ‘পারফমিং আর্ট’।
এ রচনাগুলোর সঙ্গে বহুলশ্রুত-কিন্তু-বিরলপরিচিত বিস্মকর ‘পারফমিং আর্টিস্ট’ ভি. বালসারার বিচিত্র জীবন ও ‘সংগীতপ্রতীক’ মিয়া তানসেন-এর বহুবিতর্কিত জীবন এবং কয়েকজন কিংবদন্তিপ্রতিম সংগীতব্যক্তিত্বের ওপর প্রয়োজনসাধন আলোচনা সংবলিত বর্তমান বইটির প্রাইম-মুভার প্রখ্যাত সম্পাদক আবুল হাসনাত, যিনি আমাদের শিল্পসংস্কৃতি জগতের অনেক অবদানের কেবল চালিকাশক্তিই নন, প্রাথমিক উৎসও বটেন। এ সূত্রে বিচিন্তিত এই তর্কার্থী বইটির একজন মন্দের ভাগী পাওয়া গেল বলে তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
আবদুশ শাকুর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা ঢাকা।
সূচিপত্র * শ্রোতার কৈফিয়ত * মৌলিকসংগীত ও যৌগিক সংগীত * সংগীতে তৃতীয় পক্ষ * কাব্যসংগীতের যুগস্রষ্টা পঙ্কজকুমার মল্লিক * যন্ত্রসংগীতের কিংবদন্তি পণ্ডিত ভি. বালসারা * সংগীতপ্রতীক মিয়া তানসেন * অমর সংগীতকার শচীন দেববর্মন * গানের ভুবনে ইন্দ্রপতন * মেলডিসম্রাট নওশাদ আলী * রবীন্দ্ররক্ষীবাহিনী অনাবশ্যক * বাংলা গানের মুক্তিদাতা কাজী নজরুল ইসলাম * যতীন ও হারমোনিয়ম * কলের গানের গল্প * উত্তরনের গান
আবদুশ শাকুর : জন্ম ১৯৪১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, নােয়াখালী জেলার রামেশ্বরপুর গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ এম.এ, হল্যান্ডের আই.এস.এস থেকে অর্থনীতিতে এম.এস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে যােগদান এবং বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসাবে অবসরগ্রহণ। পড়াশােনা করেন বিবিধ বিষয়ে এবং নানান ভাষায় লেখালেখির বিষয় কথাসাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ, সংগীত, সমাজতত্ত্ব ও নিসর্গ। লেখেন ঢাকার অভিজাত সকল পত্র-পত্রিকায় এবং কলকাতার বিশিষ্ট মাসিক শহর একুশ শতক’ ও ‘মিলেমিশে’ ইত্যাদিতে। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘চিরনতুন রবীন্দ্রনাথ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী এবং সঙ্গীত সংবিৎ শিল্পকলা একাডেমী। বাকি গ্রন্থাবলির প্রকাশক ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স, ঐতিহ্য, ও রােদেলা এবং কলকাতার দীপ প্রকাশন, প্রতিভাস ও একুশ শতক || আবদুশ শাকুর ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমী। অ্যাওয়ার্ড' পান ছােটগল্পের জন্য। গল্পসমগ্র'র জন্য পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে ‘অমিয়ভূষণ পুরস্কার’ পান ২০০৩ সালে। ২০০৪ সালে প্রথম আলাে বর্ষসেরা বই’ পুরস্কার পান মননশীল প্রবন্ধগ্রন্থ ‘গােলাপসংগ্রহ’র জন্য। সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের জন্য ২০০৯ সালে পান ‘অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার' এবং ২০১১ সালে ‘শ্রুতি সাংস্কৃতিক অ্যাকাডেমি পুরস্কার।