এককথায় উপমহাদেশীয় ভূখণ্ডে ধর্ম সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিভাগপূর্ব কালের তুলনায় কোনাে কোনাে দিক থেকে অধিকতর অসুস্থ। হিন্দু-মুসলমান, বৰ্ণহিন্দু বনাম দলিত, হিন্দু-খ্রিষ্টান, মুসলমান-খ্রিষ্টান, শিয়া-সুন্নি বা সুন্নি-আহমদিয়া সম্পর্ক মসৃণ তাে নয়ই, কখনাে কখনাে বিস্ফোরক স্তরে পৌঁছে যায়। স্বভাবতই আধুনিক চেতনার মানুষ, গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষ এসব ঘটনায় রীতিমতাে শঙ্কিত। চোখ বন্ধ করে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েও রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। অন্ধ হলেও যে প্রলয় বন্ধ থাকে না এটাই অনস্বীকার্য সত্য হয়ে ওঠে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, শত শত বছর ধরে একাধিক ধর্মবিশ্বাসী মানুষ এ উপমহাদেশে পাশাপাশি বাস করার পর আধুনিক যুগে পৌঁছেও তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিসরে সামাজিক-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারে নি,যেটুকু হয়েছে তা বহিরঙ্গে ও সীমিত পরিসরে। ধর্মীয় স্বাতন্ত্রবাদিতার এমনই প্রভাব যে মধ্যযুগীয় সহাবস্থান আধুনিক যুগে পৌঁছে অনৈক্য ও বিরূপতার সম্মুখীন। এ . সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তি স্মরণ করার মতাে। বাস্তবে সম্প্রদায়গত ধর্মীয় ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্রবােধ প্রধান হয়ে ওঠায় বহুভাষিক, বহুজাতিক এবং বহুধর্ম ও সংস্কৃতির ভূখণ্ডে ধর্মীয় চেতনা ভাষিক জাতিত্ববােধের চেয়ে এমনকি মানবিক বােধের চেয়েও শক্তিমান হয়ে উঠেছে, সামাজিক আচারআচরণে ধর্মীয় আবেগই যেন প্রধান। এ অবস্থা রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করার মতাে। অন্যভাবে বলা যায়, শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা অর্জন ও তা ধরে রাখার স্বার্থে রাজনীতি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে চলেছে।
প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট হিসাবে খ্যাত আহমদ রফিক, (জন্ম ১৯২৯) ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির আকর্ষণে সমভাবে আলোড়িত ছিলেন। তিনি বাহান্নার ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে তার শিক্ষাজীবন বার বার বিপর্যস্ত হয়েছে। পেশাগতভাবে শিল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে একদা যুক্ত থাকা সত্ত্বেও মননের চর্চাতেই তিনি অধিক সমর্পিত। এখন পুরোপুরি সাহিত্যকর্মে সক্রিয়। একাধিক সাহিত্য ও বিজ্ঞান পত্রিকার বিভিন্ন সামাজিক কর্মযজ্ঞে। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্টের তিনি প্রতিষ্ঠাতা, বাংলা একাডেমীর ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জীবন সদস্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শিল্প সংস্কৃতি জীবন (১৯৫৮), আরেক কালান্তরে (১৯৭৭), বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি (১৯৮৬), ভাষা আন্দােলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য (১৯৯১), রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প (১৯৯৬), জাতিসত্তার আত্মঅন্বেষা (১৯৯৭), রবীন্দ্ৰভুবন পতিসর (১৯৯৮) এবং জীবনানন্দ : সময় সমাজ ও প্রেম (১৯৯৯)। নির্বাচিত কলাম (২০০০), বাংলাদেশ : জাতীয়তা ও জাতিরাষ্ট্রের সমস্যা (২০০০), একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদ ভাষ্য (২০০১), কবিতা আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা (২০০১)। কবিতাগ্রন্থের মধ্যে নির্বাসিত নায়ক (১৯৯৬), বাউল মাটিতে মন (১৯৭০), রক্তের নিসর্গে স্বদেশ (১৯৭৯), বিপ্লব ফেরারী, তবু (১৯৯৮), পড়ন্ত রোদুরে (১৯৯৪), Selected Poems (১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৮). ভালোবাসা ভালো নেই (১৯৯৯), নির্বাচিত কবিতা (২০০১) উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার পান। সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে পেয়েছেন ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি ও স্বদেশে রবীন্দ্র পুরস্কার (১৪১৮) । এছাড়া অনেক কাঁটা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা ও স্বর্ণপদক।