"মৃত্যুক্ষুধা"বইটির প্রথমের কিছু অংশ: এক পুতুল-খেলার কৃষ্ণনগর । যেন কোন খেয়ালি শিশুর খেলাশেষের ভাঙা খেলাঘর। খােকার চলে-যাওয়া পথের পানে জননীর মত চেয়ে আছে—খােকার খেলার পুতুল সামনে নিয়ে। এরই একটেরে চাঁদ-সড়ক। একটা গােপন ব্যথার মত করে গাছ-পালার আড়ালে টেনে রাখা। তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মুসলমান আর ওমান কালি’ (রােমান ক্যাথলিক) সম্প্রদায়ের দেশী কনভার্ট ক্রীশ্চানে মিলে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে এই পাড়ায়। | এরা যে খুব সদ্ভাবে বসবাস করে এমন নয়। হিন্দুও দু’চার ঘর আছে—চানাচুর ভাজায় ঝালছিটের মত। তবে তাদেরও আভিজাত্য-গৌরব ওখানকার মুসলমানক্রীশ্চানকারুরই চাইতে কম নয়। একই-প্রভুর-পােষা বেড়াল আর কুকুর যেমন দায়ে পড়ে এ ওকে সহ্য করে— এরাও যেন তেমনি। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে গােমরায় যথেষ্ট, অথচ বেশ মােটা রকমের ঝগড়া করার মত উৎসাহ বা অবসর নেই বেচারাদের জীবনে। জাতিধর্মনির্বিশেষে এদের পুরুষরা জনমজুর খাটে—অর্থাৎ রাজমিস্ত্রি, খানসামা, বাবুর্চিগিরি বা ঐ রকমের কোনাে-একটা কিছু করে। আর, মেয়েরা ধান ভানে, ঘরগেরস্থালির কাজকর্ম করে, রাধে, কাদে এবং নানান দুঃখ ধান্দা করে পুরুষদের দুঃখ লাঘব করবার চেষ্টা করে। বিধাতা যেন দয়া করেই এদের জীবনে দুঃখকে বড় করে দেখবার অবকাশ দেননি। তাহলে হয়ত মস্তবড় একটা অঘটন ঘটত। | এরা যেন মৃত্যুর মাল-গুদাম! অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গেই সাপ্লাই! আমদানি হতে যতক্ষণ, রফতানি হতে ততক্ষণ! মাথার-ওপরে টেরির মত এদের মাঝে দু-চারজন “ভদ্দর-নুক”ও আছেন। কিন্তু এতে তাদের সৌষ্ঠব বাড়লেও গৌরব বাড়েনি। ঐটেই যেন ওদের দুঃখকে বেশী উপহাস করে। বিধাতার দেওয়া ছেলেমেয়ে এরা বিধাতার হাতেই সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে পান্তাভাত খেয়ে মজুরীতে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে এসে বড় ছেলেটাকে বেশ করে দু-ঘা ঠেঙায়, মেজটাকে সম্বন্ধের বাছবিচার না রেখে গালি দেয়, সেজটাকে দেয় লঞ্চস্, ছােটটাকে খায় চুমাে, তারপর ভাত খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। ছােট ছােট ছেলেমেয়ে—রােদে-পােড়া, ধূলিমলিন, ক্ষুধার্ত, গায়ে জামা নেই। অকারণ ঘুরে বেড়ায়, কাঠ কুড়ােয়, সুতােকাটা ঘুড়ির পেছনে ছােটে এবং সেই সঙ্গে খাটি বাঙলা ভাষার চর্চা করে। এরাই থাকে চাঁদসড়কের চাদবাজার আলাে করে। ...এই চাঁদসড়কের একটা কলতলায় জল-নেওয়া নিয়ে সেদিন মেয়েদের মধ্যে একটা ধুমখাত্তর ঝগড়া বেধে গেল। কে একজন ক্রীশ্চান মেয়ে জল নিতে গিয়ে কোন এক মুসলমান মেয়ের কলসী ছুঁয়ে
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।