ভূমিকা ষাটের দশকের মধ্য ভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনার সঙ্গে পরিচিত হই। তাঁর ‘দেশ-বিদেশে’ তখন তুমুল আলোচিত বই। বইটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়ি । তখন দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সে পড়ি। ১৯৬৬ সাল। ‘দেশ-বিদেশে’ ভ্রমণ কাহিনী। বাংলা ১৩৫৬ সনে প্রকাশিত হয়। তার আগে ধারাবাহিক ভাবে মুদ্রিত হয়েছিল কলকাতার থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। এই বইয়ের দেশ বলতে উল্লেখ করেছেন পেশোয়ারের কথা,আর বিদেশে ছিল আফগানিন্তানের রাজধানী কাবুল। এই দেশটির চমৎকার পর্যক্ষেণ তাঁর শাণিত লেখনীর ঝলসে উঠেছে।অসাধারণ গদ্যভঙ্গিতে তিনি বয়ান করেছেন নানা ঘটনা। কাবুল ছেড়ে আসার পথে বিমান বন্দরে পাওয়ার সময় তিনি লিখছেন: ‘‘আমার পাশের বাড়ীর কর্নেলের মায়ের কান্না,ইস্কুলের কর্নেলে-বউয়ের কান্না আরো কত কান্না মিশের দিয়ে অহরহ খুদাতালার তখতের দিকে চলছে। কিন্তু কেন? কবি বলেছেন, For men must work And women must weep “অর্থ্যাৎ কোনো তর্ক নেই,ন্যায় অন্যায় নেই,মেয়েদের কর্ম হচ্ছে পুরুষদের আখাট মূর্খতার জন্য চোখের জল ফেলে খেসোরতি দেওয়া। কিন্তু আশ্চর্য ,এ-বেদনাটা প্রকাশ করেও আসছে পুরুষই,কবিরূপে। শুনেছি পাঁচ হাজার বছরের পুরানো বাবিলনের গ্রস্তরগাত্রে কবিতা পাওয়া গিয়েছে-কবি-মা-জননীদের চোখের জলে উল্লেখ করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।” কাবুলের পর্বতের চূড়ায় মোগল সম্রাট বাবুরের সমাধি দেখে তাঁ অনুভব এমন- “ইংরেজী ‘সার্ভে’ কথাটা গুজরাতীতে অনুবাদ করা হয় ‘সিংহাবলোকন’দিয়ে। ‘বাবুর’ শব্দের অর্থ সিংহ। আমার মনে হল এই উঁচু পাহাড়ের উপর বাবুরে গোর দেওয়া সার্থক হয়েছে। এখান থেকে সমস্ত কাবুল উপত্যকা, পূর্বের ভারতমূখী গিরিশ্রেণি , উত্তরে ফরগনা যাবার পথে হিন্দুকুশ,সব কিছু ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সিংহাবলোকনে দেখেছেন সিংহরাজ বাবুর।’” পুরো বই জুড়ে লেখকের অসংখ্য ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে হতে বই শেষ হয়ে যায়। মনে গেঁথে থাকে টুকরো টুকরো বিষয়।যেমন “গ্রীক দেবতা প্রমিথিয়ুস ও দেবরাজ জুপিটরে কলহ হয়ছিল অগ্নি নিয়ে। মানব -সভ্যতার আরম্ভ হয় প্রমিথিয়ুসের কাছ থেকে পাওয়া সেই অগ্নি দিয়ে। নলরাজ ইন্ধন প্রজ্বলনে সচতুর ছিলেন বলেই কি তিনি দেবতাদের ঈর্ষাভাজন হলেন? ‘নল’ শব্দের অর্থ ‘চোঙা’ ,প্রমিথিয়ৃস আগৃন চুরি করে ছিলেন চোঙার ভিতর করে। ভারতীয় আর্য,গ্রীক আর্য দুই গোষ্ঠী, এবং তৃতীয় গোষ্ঠী ইরানী আর্য জরথস্ত্রী সকলেই অগ্নিকে সম্মান করে। হয়তো এঁরা সকলেই এককালে শীতের দেশে ছিলেন এবং অগ্নির মূল্য এরা জানতেন,কিন্তু সেমিতিভুমি উষ্ণপ্রধান ,সেখানে অগ্নি-মাহাত্ম্যকেন? তবে কি মরুভুমির মানুষ সূর্যের একচ্ছত্রাধিপত্য সম্বদ্ধে এতই সচেতন যে, বিশ্বব্রক্ষাণ্ডের একচ্ছত্রাধিপতির রুদ্ররূপ বা ‘তজল্লিতে’অগ্নিই আবাস পায়? এসব চিন্তা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাকে ভাবিয়েছিল। বুঝেছিলাম ভ্রমণকাহিনীর ভিন্ন মাত্র তৈরি করেছিলেন লেখক। সৈয়দ মুজতবা আলীর জ্ঞানচর্চার অনুশীলন আমাকে তরুণ বয়সে পথ দেখায় । তাঁর সাহিত্য চর্চার কৌশল আমার কাছে শিক্ষণীয় হয়েছিল । বিশিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা ষ্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলীর পঞ্চম খন্ডের ভূমিকা লেখার দায়িত্ব পেয়ে এসব স্মৃতিই প্রথমে আমার মনে ভেসে ওঠে। বিষ্ময়ে ভাবী, একজন পাঠকের কাছে লেখকের রচনা কত গভীরভাবে স্থায়ী হয়ে যায়। ‘দেশে বিদেশে’ বই থেকে যেসব উদ্ধৃতি ডায়েরিতে লিখেছিলাম সে ডায়েরি এখন আর আমার কাছে নেই । কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলীর ছবিটি এখনও আমার মনের অ্যালবামে আছে। ‘দেশ বিদেশে বই পড়ার দু’চার মাস পরন রাজশাহী শহরের একটি স্টুডিওতে ছবি তুলতে যাই । বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম পূরণ করার জন্য ছবির দরকার । ছবি তোলা শেষ হয়ে যায়। বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ একটি ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি ,সেই ছবিটি কার ? স্টুডিওর মালিক অম্লান বদনে বলেন, সৈয়দ মুজতাবা আলী। মুজতবা আলী! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। স্টুডিওর মালিক আমার বিস্মিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, অনেক বড় মানুষ। বড় লেখক। আমার কাছে অনেক গুলো কপি আছে। নেবেন একটা? আমি হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো হাত বাড়াই। যেন এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু আমার পা্ওয়ার ছিল না। একজন লেখকের একটি ছবি এমনই মূল্যবান হয়ে উঠেছিল আমার কাছে। যার রচনা পড়ে তরুন বয়সে একদিন ঘোর কাটাতে সময় লেগেছিল আজ তাঁর রচনাবলীরি একটি খন্ডের ভূমিকা লেখা কত অনায়াস মনে হচ্ছে। ইতিহাসের চাকা বুঝি এভাবে ঘুরতে থাকে। এই খন্ডে সংকলিত হবে চারটি বই। বইগুলো হল:পঞ্চতন্ত্র (দ্বিতীয় পর্ব);রাজাউজির ;শহর ইয়ার ও কতনা অশ্রুজল। এর মধ্যে শহর ইয়ার উপন্যাস । বাকি তিনটি বই তির্যক ক্ষুদ্র রচনার সংকলন। শুধু রম্য রচনা বলে শুধু ক্ষুদ্র আকারের নিবন্ধগুলোকে অভিহিত করা যাবে না্ । কারণ এসব রচনায় রম্য-রসিকতা-হাস্য-কৌতুকের পাশাপশি জ্ঞান,প্রজ্ঞা.,মননশীলতা এবং মানসিক বোধের তীক্ষ্ণ সংযোজন আছে।এই অর্থে এই রচনাসমষ্টি ব্যতিক্রমী বিশিষ্টতায় ভিন্নধর্মী। এই ধরনের প্রথম রচনা সংকলন ‘পঞ্চতন্ত্র (প্রথম পর্ব), প্রকাশিত হয় ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে । দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হয় ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ । পঞ্চতন্ত্র প্রথম পর্বের সূচনায লেখক লেখেছেন, ‘ এই পুস্তিকার অধিকাংশ লেখা রবিবারের ‘বসুমতী, ও সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরোয়। অনুজ প্রতিম শ্রীমাণ কানাই সরকার ও সুসাহিত্যক শ্রীযুক্ত মনোজ বসু কেন যে এগুলো পুস্তিকারে প্রকাশ করার জন্য আমাকে বাধ্য করলেন সে কথা সুহৃদয় পাঠকেরা বিবেচনা করে দেখবেন। ‘নয়াদিল্লী, আষাঢ়,১৩৫৯। সৈয়দ মুজতবা আলী ।’ পঞ্চতন্ত্র প্রথম পর্বে সন্নিবেশিত হয়েছে পঁয়ত্রিশটি প্রবন্ধ। রচনাবলীর পঞ্চম খন্ডে সংযোজিত হয়েছে দ্বিতীয় পর্ব। এই্ পর্বে আছে চৌত্রিশটি নিবন্ধ। লেখক নিজে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে কেন এগুলো নিয়ে বই করা হলো। আসলে তিনি বিনয় প্রকাশ করেছেন এ্টা বলার অপেক্ষা করে না। আকারে ক্ষুদ্র ,কিন্তু চরিত্রে তীক্ষ্ণ এবং বিশিষ্টতায় অনবদ্য এমন লেখাগুলোর কোনটা ছেড়ে কোনটা উল্লেখ করা উচিত সেটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম নিবন্ধের নাম ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’। লিখলেছন- “কলকাতায় এসে শুনতে পেলুম, বর্তমানে নাকি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মরসুম যাচ্ছে। আশ্চার্য লাগলো। বষ্কিম আরম্ভ করলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন সামাজিক-কিঞ্চিৎ রোমাণ্টিক-ঘ্যাঁষা-উপন্যাস,শরৎচন্দ্র লিখলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিয়ে , তারা শঙ্কর তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায় নিয়ে । এর পর আবার হটাৎ ঐতিহাসিক উপন্যাকে কি করে যে ডুব সাঁতারে রিটার্ণজার্নি মারলে ঠিক বুঝা গেল না। আমি গণতন্ত্র বিশ্বাস করি ;কাজেই আর পাঁচজনের মতো হতভম্ব হতে আমার কোন আপত্তি নেই।” এই উদ্ধৃত্তির শেষে বাক্যটি লক্ষণীয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে হতভম্ব শব্দ এমন চমৎকার মেলানোর সাধ্য খুব কম রসিকজনের পক্ষেই সম্ভব। সৃজনশীল চিন্তার মানুষ না হলে এই কাজটি করা প্রায়ই অসম্ভব। এমনই ঈর্ষাণীয় মুজতবা আলী-এজন্যেই তাকে স্মরণ করা। আড়াই পৃষ্ঠার এই ক্ষুদ্র লেখায় এরপরে তিনি মোগল ইতিহাস প্রসঙ্গে বলেছেন। তার পর এসে অন্যত্র। লিখেছেন- “মারাঠারা যখন গুজরাত সু’বা (বা সুবে অর্থ্যাৎ প্রদেশ, প্রভিন্স)দখল করে তার রাজধানী আহমাদাবাদে ঢুকল তখন সেখানকার দেওয়ান(প্রাদেশিক প্রধান মন্ত্রী) মুহাফিজখানার (আর্কাইভস-এর )তাবৎ কগজপত্র বাড়ি নিয়ে গিয়ে গুজরাত কাঠিয়াওয়াডের একখানা প্রামাণিক ইতিহিাস লেখেন। বইখানি তিনি দিল্লির বাদশা সালামত মুহম্মদ শাহ বাদশাহ রঙ্গীলাকে ডেডিকেট করেন। ইতিহাসের নাম মিরাৎ-ই-আদমী’। পুস্তকের মোকদ্দমা১ তিনি বাদশাহ সালামতকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, রাজনীতি অনুসরণ করার ফলে দিল্লির বাদশারা গুজরাতের মতমাথার মলি প্রদেশ হারালেন সে নীতি যদি না বদলানো হয় তবে তাবৎ হিন্দুস্থানেই যাবে। সেই নীতির প্রাথমিক স্বর্ণযুগ,ত্রুমবিকাশ ও অধঃপতন তিনি সেই ইতিহাসে ধারাবাহিক লিপিবব্ধ করেছেন।সেই ইতিহাস থেকে একটি ঘটনা মনেপড়ল। স্মৃতি শক্তির উপর নির্ভর করে লিখছি-তাই আবার বলছি ভূলচুক হলে ধরে নেবেন, এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।’’ এর পরের অংশ গুজরাটের দুর্ভিক্ষের বর্ণনা। বলেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পর পর কয়েক বছর দুর্ভিক্ষ হয়। এই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার জন্য তৎকালীন গুজরাট প্রদেশের সৃবাদার এবং বিত্তশালী শ্রেষ্ঠীরা কি ব্যবস্থা করোছিলেন তার বর্ণনা করেছেন। লেখাটি পড়ে শেষ না করে যে কেউ স্তম্বিত হয়ে যাবেন । আজকের দিনে আমরা গলা ফটিয়ে সুশাসনের কথা বলি । গুড গভার্নেসের না মে সেমিনার ,সিম্পোজিয়াম,ওয়ার্কশপ কত কিছুর আয়োজন করা হয়। কিন্তু মুজতবা আলী মাত্র দুই পৃষ্টার সুশাসনের স্বরুপ ইতিহাসের নামে দেখিয়ে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত্ দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য- ‘‘সুবেদার সেই শ্রেষ্ঠীকে শুধালেন দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য কিছু করা যায় কি না। শ্রেষ্ঠী বললেন,মালওয়া অঞ্চরে এবারে প্রচুর ফসল ফলেছে,সেখানে গম,চাল পাওয়া যাবে। তবে দুই প্রদেশের মাঝখানে দারুণ দুর্ভিক্ষ । মালবহী গাড়ি লুট হবে। অতএব তিনি দুই শর্তে দুর্ভিক্ষ মোচনের চেষ্টা করতে পারেন।: এক সুবেদার নিরাপদে মার আনানোর জন্য সঙ্গে গার্ডরুপে ফৌজ পাঠাবেন। 2। মাল এসে পৌছলে সুবেদার যে দাম বেধে দেবেন মুদীরা যদি তার বেশী দাম নেয় তবে তদ্দন্ডেই তাদের কঠোর সাজা দেবার জিম্মাদারী সুবেদার নেবেন। সুবেদার সানন্দে সম্মতি দিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠী সুবেদারের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য চান নি। বাড়িতে এসে শ্রেষ্ঠ বংশানুক্রমে সঞ্চিত অর্থ ,অলংকার,জওহরাত বের করলেন ,স্ত্রী কন্যাকে তাদের অলঙ্কার পর্যন্ত খুলে দিতে বললেন। সেই সমস্ত ঐশ্বর্যভানডার নিয়ে শ্রেষ্ঠির কর্মচারীরা সুবেদার ফৌজ সহ মালওয়া পানে রওয়ানা দিলেন । কিছুতিন পরেই মুখে মুখে অহমদাবাদে পৌছল শ্রেষ্ঠী তাঁর একাধিক হাভেলি। বিরাট চক মেলানো বাড়ি, এবসঙ্গে গোষ্ঠির বহু পরিবার একই বাড়িতে বসবাস করতে পারে। খুলে দিয়ে আঙ্গিনার েউপরসেসব রখরেন। কার পর সুবেদারের সঙ্গে হিসেব করলেন, কি দরে কেনা হয়েছে, রাহ-খর্চা(ট্রান্সপোর্ট) কত পড়েছে এবং তাহলে এখন কি তর বেঁধে দেওয়া যায়? সুবেদার বললেন, আর আপনার মুনাফা? শ্রেষ্ঠী বললেন,‘যুগ যুগ ধরে মুনাফা করেছি ব্যবসা বানিজ্যে! এ ব্যবসাতে করবোনা । যা খরচা পড়েছে সে ধরে বেধে দিন। মুদীর সামান্য লাভ থাকবে।‘দাম বেঁধে দেওয়া হল। এবারে শুনুন,সবচেয়ে তাজ্জবতী বাৎ।
বিশিষ্ট পণ্ডিত ও রম্যরচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। শুধু রম্যরচনাই নয়, ছোটগল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনী সাহিত্যের ইত্যাদি বিশেষ শাখায় রচিত সৈয়দ মুজতবা আলী এর বই সমূহ অর্জন করেছে বিশেষ খ্যাতি। বিশেষ করে তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনীগুলোর জুড়ি নেই, যেগুলো পাঠকদের কাছেও ব্যাপক সমাদৃত। বিখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস সিলেটের মৌলভীবাজারে হলেও তাঁর বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলীর বদলির চাকরির সুবাদে শৈশব ও শিক্ষাজীবন কেটেছে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে৷ স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়ে তিনি ১৯২১ সালে ভর্তি হন বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী-তে, যেখানে তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। এখান থেকে ১৯২৬ সালে তিনি শুধু স্নাতকই পাশ করেননি, লাভ করেছেন ইংরেজি, সংস্কৃত, ফরাসি, হিন্দি, ফারসি, জার্মান, আরবি ইত্যাদি ভাষায় দক্ষতা। এই অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন সাহিত্যিকের পড়াশোনা এখানেই শেষ নয়, এরপর তিনি পড়াশোনা করেছেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি তিনি জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে পড়েছেন বৃত্তিসহ। শুধু তা-ই নয়, ১৯৩২ সালে 'তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব' বিষয়ে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। কর্মজীবনে তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী এর বই ছাড়াও বেশ কিছু লেখালেখি রয়েছে, 'সত্যপীর', 'প্রিয়দর্শী' ইত্যাদি বিভিন্ন ছদ্মনামে বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকায় তিনি লিখেছেন। গভীর জীবনবোধ, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা ও বিভিন্ন শ্লোক-রূপকের যথার্থ ব্যবহার সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সৈয়দ মুজতবা আলী এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'দেশে বিদেশে', 'জলে ডাঙ্গায়' ইত্যাদি ভ্রমণকাহিনী, 'শবনম', 'অবিশ্বাস্য' ইত্যাদি উপন্যাস, 'চাচা কাহিনী', 'টুনি মেম', 'ময়ূরকণ্ঠী' ইত্যাদি ছোটগল্পগ্রন্থ এবং 'পুনশ্চ', 'ক্যাফে-দে-জেনি', 'রস-গোল্লা', 'বিধবা বিবাহ' ইত্যাদি গল্পমালা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধ গ্রন্থ, যার মধ্যে 'পঞ্চতন্ত্র' অন্যতম। এই অসামান্য সাহিত্যিক ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।