ভূমিকা বাঙালির জন্য রবীন্দ্রনাথ একটি জ্যোতিষ্ক মাত্র নয়, বরং বিশাল আকাশ। এই আকাশটি আমাদের মাথার ওপর ধরা আছে বলেই আজও সঙ্কটে দূযোর্গে আমরা নির্ভয়। আমাদের আনন্দে বেদনায় , শোকে উল্লাসে রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর মতো আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান, আমাদের হাত ধরেন। আমাদের উৎসবে অনুষ্ঠানে , পালা পার্বনে ,সংগ্রামে সন্তাপে ভাষা যোগান রবীন্দ্রনাথ। আমরা আজ যে ভাষায় কথা বলি তা রবীন্দ্রনাথের। এক রবীন্দ্রনাথই তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অন্তত পক্ষে একশো বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন। সেদিক থেকে বাঙালির জন্য রবীন্দ্রনাথকে জানার , তাঁর রচনা পাঠের কোনো বিকল্প নেই।এমনিতে রবীন্দ্র রচনার সঙ্গে আমাদের অধিকাংশের পরিচয় ঘটে মূলত পাঠ্য বইয়ের সংকলিত দু’চারটি কবিতা বা গল্পের মাধ্যমে। তবে অনেকের বেলায়ই পরিচয়ের পরিধিটা শেষ পর্যন্ত ওই গন্ডি ছাড়িয়ে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না। দুঃখজনক হলেও কথাটি সত্য। আজকের দিনে একদিকে শিক্ষার বাণিজ্যকরণ এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তরফে পরীক্ষায় ভালো ফল লাভের অনন্য মুখী প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে ইলেকট্রনিক প্রচারমাধ্যেমের সর্বগ্রাসী প্রভাব তথা আকাশ সংস্কৃতির দাপটে যখন কিশোর তরুনদের মধ্যে ‘বাইরের বই’ বিশেষ করে সাহিত্য পাঠের সমস ও আগ্রহ নিদারুন ভাবে কমে আসছে,গ্রীষ্মবকাশ কিংবা বাৎসরিক পরীক্ষার শেষে ফল বেরুবার অপেক্ষায় দিন গুলো তার গল্পগুচ্ছ পড়ার আনন্দময় অভিজ্ঞতায় ভরে তুলবে , এমন আশা যখন প্রায় দুরাশা , তখন এধরনের সীমিতায়তন সংকলন গ্রন্থের বিশেষ উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলো রবীন্দ্রনাথ কিশোরদের কথা ভেবে, কিংবা একান্ত ভাবে তাদের উপযোগি করে লিখেছেন এমন কথা কিছুতেই বলা যাবে না্। বস্তুত সমগ্র রবীন্দ্রসাহিত্যের বিচারে সে রকম রচনার সংখ্যা বেশি নয়। তবে বাংলা ভাষায় এ যাবতকালের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভার উজ্জ্বল কিছু সৃষ্টির স্বাদ গ্রহণের পাশাপাশি রবীন্দ্ররচনায় আলোকময় জগতের প্রতি নবীন পাঠকদের ঔৎসুক্য সৃষ্টিতে এই সংকলটি হয়তো সহায়ক হবে। দুদশক আগে বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের কিশোররোপযোগী গদ্যপদ্য রচনা সংকলন কৈশোরক এর পথ ধরে কিংবা তারই ভিত্তিতে রবীন্দ্ররচনার এজাতীয় সংকলন ইতিমধ্যে, বিশেষ করে রবীন্দ্র রচনার গ্রন্থসত্ত উঠে যাওয়ার পর, যেমন পশ্চিম বাংলায় তেমনি বাংলাদেশেও কিছু কিছু বের হয়েছে। আগামীতেও নিশ্চয় আরো বেরুবে। আর তাতে লাভ বা বৈ কারো ক্ষতি নেই। যদি অবশ্য প্রকাশকরা নির্ভুল ছাপা ও প্রকাশনা মানের ব্যাপারে যত্নবান থাকেন। আশা করি বর্তমান সংকলনটি সে আশা পূরণ করেছে। ‘রবীন্দ্রনাথা ঠাকুরের কিশোর গল্প’ নামের এই বইটি যদি আমাদের উঠতি তরুন বা কিশোর বয়সী পাঠকদের রবীন্দ্রসাহিত্য ভুবনে বিপুল রত্নরাজির অন্তত একাংশের সঙ্গেও পরিচয় ঘটাতে সক্ষম হয় তবে প্রাপ্তি হিসেবে তাও বলব কম নয়। মোরশেদ শফিউল হাসান
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।