সাম্প্রদায়িকতা সংস্কৃতির সংকট সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (দ্বিতীয় খণ্ড)
বদরুদ্দীন উমর একালের একজন অগ্রগণ্য মার্কসীয় রাজনীতিবিদ এবং শীর্ষস্থানীয় চিন্তক। বিনা তর্কে এ কথা মেনে নেওয়া যায়। তাঁর সক্রিয় রাজনৈতিক তৎপরতা প্রবহমান। সেই সঙ্গে নানামুখী চিন্তার প্রকাশ তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁর রাজনীতি এবং চিন্তা দুইই পরস্পর সম্পর্কিত—অবিচ্ছেদ্য। তিনি মানুষের চিন্তার সঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক চরিত্র বিচার করতে আগ্রহী। কারণ মানুষের রাজনৈতিক চরিত্র তার চিন্তাকে প্রকাশ করে; আবার মানুষের চিন্তাভাবনাও তার সামাজিক রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক চরিত্রকে তুলে ধরে। বদরুদ্দীন উমরের সমস্ত চিন্তাভাবনার গোড়ায় রয়েছে এইরকম এক মৌল নীতি। চিন্তাক্ষেত্রে, তিনি ইতিহাসের সমস্ত ঘটনার মধ্যে রাজনীতির শক্তিকে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। দর্শনগত এই মৌল নীতি তাঁর চিন্তাভাবনার প্রধান কথা। বদরুদ্দীন উমরের এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় নব্বই। এ গ্রন্থগুলির অধিকাংশই আজ আর বাজারে পাওয়া যায় না। তিনি বাংলা এবং ইংরেজি দু-ভাষাতেই অক্লান্তভাবে লিখেছেন এবং লিখছেন। দু-ভাষাতেই তাঁর সমান দখল। তাঁর অজ¯্র লেখালেখির সঙ্গে আমাদের সবার পরিচয় সমান নয়। বিশেষত, আজ যাঁদের বয়স ত্রিশ, তাঁদের চেষ্টা থাকলেও বদরুদ্দীন উমর তিন-চার দশক আগে কী লিখেছেন, সেটা তাঁদের জানার কোনো উপায় নেই। অন্তত এই বিবেচনাতেও তাঁর রচনাবলী আরো দশ বছর আগে থেকে প্রকাশ হওয়া উচিত ছিল। তাঁর রচনাবলীর ঐতিহাসিক ও সামাজিক গুরুত্ব, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব, সাংস্কৃতিক ও সমকালীনতার গুরুত্ব আজ কারো অজানা ব্যাপার নয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় ও মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় তাঁর অতুলনীয় অবদানের কথা জানতে হলে তাঁর সমস্ত রচনা পাঠকদের সামনে থাকা দরকার।
বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিম বাঙলার বর্ধমান শহরে। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি বাঙলাদেশে সুপরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করার আগেই ১৯৫৪ সালে দর্শন বিভাগে অস্থায়ীভাবে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে এম. এ. পাশ করার পর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে এবং ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি এই তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্ৰী অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। ষাটের দশকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) তত্ত্বকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় পাকিস্তান সরকারের সাথে তাঁর বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং তিনি নিজেই ১৯৬৮ সালে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।