ফ্ল্যাপে লিখা কথা হাসান আজিজুল হক অর্ধশতাব্দীব্যাপী সাহিত্য সৃজনে অনলভাবে ব্যাপৃত।তিনি আমাদের এদেশেই শুধূ নয়, সাম্প্রতিক বঙ্গ সাহিত্যে উজ্জলতম কথা সাহিত্যিকদের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তাঁর রচনা, চিন্তা -ভাবনা সম্পর্কে -সমাজ ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই -বিদ্বজ্জনের রচনা দু বাংলাতেই বহুকাল যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। রসগ্রাহী ছাত্র /শিক্ষক অনেকেই তাঁদের গবেষণার যোগ্য হিসেবে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে গ্রহণ করেছেন। তাঁর অদ্যাবধি প্রকাশিত গল্প গ্রন্থ ন’টি এবং উপন্যাস তিনটি -অনেকের মতে প্রথমটি দশ আর দ্বিতীয়টি দুই -প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সাতটি প্রবন্ধ গ্রন্থ ও দার্শনিক সক্রেটিস বিষয়ে একটি পূর্ণাবয়ব গ্রন্থ । বর্তমান ‘নির্বাচিত হাসান আজিজুল হক’ মূলতই নির্বাচন, তাঁকে পুরোপুরি বুঝা যাবে এমন এক সংকলন। ভুমিকা আমাদের বন্ধু হাসান আজিজুল হকের রচনাসমগ্র বেরিয়ে গেছে এখন পর্যন্ত পাঁচ খন্ডে, ভবিষ্যতে আরো কয়েক খন্ড কি না বেরোবে, যখন ভাবি তখন বিস্ময়ে অবাক মানি বললে মনের ভাব ফুটবে না, আসলেই হতভম্ব হয়ে যাই। আশ্চর্য ! হাসান এতো লিখলেন কবে, কখন কিভাবে? তাহলে আড্ডা দিলেন কখন? আমি মেলাতে পারি না। আমরা গৌড়জন বিলক্ষন জানি। আর ,তাঁর মতো বলল কথন, সেই-বা কজনের ললাট লিপি! কী আনুষ্ঠানিক মঞ্চে, সভা-সমিতিতে কি ঘরোয়া রাজউজির মারা-আড্ডায় তাঁর তুলনা তিনি নিজিই। সর্বত্র বাজিমাত। অনায়াসসাধ্য,অচর্চিত,স্বতোৎসারিত,অদম্য,নিনাদিত শব্দপ্রস্রবন। আমার চেনা চৌহদ্দীদতে বাকশিল্প,কথা মধুময়, মানুষ দ’চারজন আছেন্ বৈকি, সকলেই নিজ নিজ ধরনের স্বাতন্ত্রিক , কিন্তু সেখানেও হাসান বিশিষ্ট। বৈশিষ্ট্যের হেতু তাঁর কন্ঠস্বর বা বাচনভঙ্গি নয়, হেতু তাঁর অনর্গল চমকে দেওয়ার মতো বাকবৈদগ্ধ্য: বাক্যবিন্যাস আকস্মিক অলঙ্কার -উপমা-সংকেত - তির্যকতা এবং মাঝখানে বিনিসুতার মালার গাঁথুনি থাকে ঈষৎ শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠের উচ্চরোল হাস্যধবনি। এই হাসান আজিজুল হক নামধারী ব্যাক্তিমানুষটি তাঁর ঋজু ও তেজি চেহারা নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর যাবতীয় কাহিনী পরম্পরায় ,গল্পে কি উপন্যাসে, এমনকি প্রবন্ধরাজিতেও।আমাদের মতো দুর্মুখ বন্ধুদের ধরতাই বুলি- হাসান বড়ো অলস, লেখেন কম , এই অভিযোগ এখন অবধি তাঁর সঙ্গি। আমাদের সঙ্গে কাতারে দাড়াবেন, আমি জানি , কাগজের (লিটল ম্যাগ ও দৈনিক সংবাদপত্র ইত্যাদি) সম্পাদকবৃন্দ ও প্রকাশককুল; তাঁরা জানেন এই মানুষটির হাত থেকে লেখা আদায় করা কতখানি কাঠখড় পোড়ানোর ব্যাপার । সরল-যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ করলে অঙ্কের ফল দাঁড়ায়, তিনি অতি প্রজ নন। আসলেই কি তাই?নাকি আমাদের চতুষ্পার্শ্বে নিরন্তর প্রায় -অপাঠ্য রচনার যে প্লাবন তার ঘূর্ণি ভূলিয়ে দিয়েছে তৌলের হিসাবজ্ঞান? স্বল্পপ্রজ হলে- কিংবা হয়তো তা-ই , তাতে কী-হীরকদুতিময় এতসব রচনা কী করে সম্ভব হল!অবশ্য এমনও ঘটতে পারে -একই সঙ্গে প্রচুর অথচ অত্যুত্তম লেখা প্রায় সোনার পাথরবাটি নির্মান। আমার বিশ্বাস , পাঠক সমাজের এত কোনো আক্ষেপ নেই।আর আমরা ,বন্ধুবাহিনী! বন্ধুর চেয়ে শত্রু আর কে,যদি বন্ধু শত্রুতা করতে চায়। আমরা তাঁর পিছনে লেগেই আছি এবং উত্তক্ত্য করবই। সপ্ততিস্পর্শী বয়ঃক্রমকালে সতীলক্ষী ধর্মপত্নী যেমন ত্যাগ করা যায় না, তেমনি সুপ্রাচীন বান্ধবদেরও -এমনকি শত্রুপদপ্রাচ্য হলেও-দুঃচ্ছাই বলা অসম্ভব । সে আমরা ভালই জানি। ২ হাসান আজিজুল হকের অদ্যাবধি প্রকাশিত ৯ টি গল্পগ্রন্থ , ২টি কি তিনটি উপন্যাস, ৭টি প্রবন্ধ সংকলন এবং গ্রিক দার্শনিক সোক্রাতেস নিয়ে লেখা ১ টি বই -এসব থেকে ছেঁকে ঝাড়াই-বাছই করে প্রতিনিধিত্ব মূলক কোন হাসান -সংগ্রহ প্রায় এক দুঃসাধ্য কর্ম। এর কারণ তাঁর সকল গল্পই অন্য সব গল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী। লেখকের ব্যাক্তিগত দূর্বলতা একেবারেই বিবেচানয় না আনার পরেও দেখা যাবে ,পাঠকের পক্ষপাত সকলের প্রতিই । এর ফলে ‘প্রতিনিধিত্বমূলক ‘ সত্যি-সত্যিই করতে চাইলে তাঁর সব লেখা নিয়ে রচনাসমগ্র বের করাই সঙ্গত, ‘নির্বাচিত’ সংকলনের চিন্তা অস্বস্তিদায়ক হতে বাধ্য। তাই আমরা পূর্ণ অবিহিত যে , এখানে নির্বাচিত রচনাদি বিষয়ে বোদ্ধা পাঠক প্রশ্ন তুলতেই পারেন। পাঠকের পরিতৃপ্তি দানে সর্বাংশে সফল হব না জেনেও এমন গন্থের পরিকল্পনা যে গ্রহণ করতে হলো তা কারণ-রসগ্রহিষ্ণু পাঠকের সামনে এমন একটি সংকলন থাকা প্রয়োজন যাতে খন্ডিত অবয়বে নয়,- বরং বলা ভালো বামনাকারে- সবটুকুই অথচ খাটো করে নিয়ে , হাসান কে পাওয়া যায়। সুধীজনের অবহিতির জন্য অবশ্য এটুকু বলা প্রয়োজন যে রচনাদি বিন্যস্ত হয়েছে গ্রন্থের প্রকাশ- সালের অনুক্রম মান্য করে। গল্প-সংকলণ সমূহের ক্রমপরম্পরা এরকম: সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), নামবহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), আত্নজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), পাতালে -হাসপাতালে (১৯৮১), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রোদে যাব(১৯৯৫), মা-মেয়ের সংসার (১৯৯৭),বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)। ‘বৃত্তায়ন’ নামে রচনাটি কথনো বড়োগল্প, আবার কখনো উপন্যাস হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। কিন্তু আমরা একে বিবেচনা করছি বড়ো গল্প বলে। সাহিত্যের কোন ধারা বা genre-এর ভিতরে লেখাটিকে ফেলা যাবে , তা নিয়ে কোনো তর্কবুদ্ধিকে আমরা প্রশ্রয় দিই নি। ১৯৬০ সালে রচিত ও ক্রমপ্রকাশিত ‘বৃত্তায়ন’ বিষয়ে লেখক নির্মোহ, গ্রন্থকারে বহুবছর ছাপেন নি, মুদ্রিত হয়েছে প্রকাশকদের আগ্রহে। আমরা পরিত্যাজ্য মনি করিনি -এ জন্যে যে, লেখকের লেখক হওয়ার আদি দলিল হিসেবে এও থাকুক অন্যদের সঙ্গে ,অপরিণতই যদি হয় তো অন্যদের পিছনে থেকে অনুসরণ করুক ; সে কারনে সকল গল্পের শেষে তার গল্প। অসৃজনশীল গদ্য -রচনা, ইংরেজিতে যাকে আমরা নন্-ফিকশনাল প্রোজ বলতে অভ্যস্ত, গল্প -উপন্যাস বিভাগের মতো আনুক্রমিকভাবেই বিন্যস্ত হয়েছে। যেমন-কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১), সক্রেটিস (১৯৮৬), অপ্রকাশের ভার (১৯৮৮), অতলের আঁখি (১৯৯৮), কথা লেখা কথা (২০০৩) থেকে নির্বাচিত রচনাদি। ৩ হাসান আজিজুল হক অর্ধশতাব্দী ব্যাপী সাহিত্য সৃজনে অলসভাবে ব্যাপৃত। তিনি আমাদের এদেশেই শুধু নয়,সাম্প্রতিক বঙ্গ সাহিত্যে উজ্জলতম কথা সাহিত্যিকদের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তাঁর রচনা, চিন্তা -ভাবনা সম্পর্কে -সমাজ ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই -বিদ্বজ্জনের রচনা দু বাংলাতেই বহুকাল যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। রসগ্রাহী ছাত্র /শিক্ষক অনেকেই তাঁদের গবেষণার যোগ্য হিসেবে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে গ্রহণ করেছেন, আমি জানি। বর্তমান সংকলন গন্থের উদ্দেশ্য তাঁর সূচনার মূল্যায়ন নয়। সে গুনাগুনের ভার দেশে ও বিদেশে ছড়ানো বাঙালির হাতে এবং মহাকালের দরবারে। এ কারণেই আমি রচনাবিশ্লেষণে কোনো দায়িত্ব গ্রহন করিনি। আমার বিবেচনায় , কোনো শিল্পবস্তুর ‘মাষ্টারি’ শবব্যচ্ছেদ আসলে রসিকচিত্তের কান্ডজ্ঞান ও স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে পর্যুদস্ত করে, তাতে অপকারই হয়- স্বাধীনচিন্তার ক্ষেত্রে সংশয় ও ভয় এসে উঁকি মারে।সাম্প্রতিক বঙ্গ সাহিত্যে উজ্জলতম কথা সাহিত্যিকদের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তাঁর রচনা, চিন্তা -ভাবনা সম্পর্কে -সমাজ ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই -বিদ্বজ্জনের রচনা দু বাংলাতেই বহুকাল যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। রসগ্রাহী ছাত্র /শিক্ষক অনেকেই তাঁদের গবেষণার যোগ্য হিসেবে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে গ্রহণ করেছেন। হাসানের রচনা কোন তত্ত্ব বা বিশ্লেষণের মুখাপেক্ষী নয়। আমার তেমন প্রয়াস নিতান্ত পশুশ্রম হত, তাই সে- চেষ্টা করি নি।সাম্প্রতিক বঙ্গ সাহিত্যে উজ্জলতম কথা সাহিত্যিকদের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তাঁর রচনা, চিন্তা -ভাবনা সম্পর্কে -সমাজ ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই -বিদ্বজ্জনের রচনা দু বাংলাতেই বহুকাল যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। রসগ্রাহী ছাত্র /শিক্ষক অনেকেই তাঁদের গবেষণার যোগ্য হিসেবে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে গ্রহণ করেছেন। অধিকন্তু আমার বিশ্বাস,হাসান আজিজুল হক তাঁর পাঠকদের নিকটেই পেীঁছুতে চান, সাহিত্যের ডাক্তার -বদ্যির কাছে নয়। সাম্প্রতিক বঙ্গ সাহিত্যে উজ্জলতম কথা সাহিত্যিকদের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তাঁর রচনা, চিন্তা -ভাবনা সম্পর্কে -সমাজ ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই -বিদ্বজ্জনের রচনা দু বাংলাতেই বহুকাল যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। রসগ্রাহী ছাত্র /শিক্ষক অনেকেই তাঁদের গবেষণার যোগ্য হিসেবে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে গ্রহণ করেছেন। হায়াৎ মামুদ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ ১০২/এ,দীননাথ সেন রোড গেণ্ডারিয়া, ঢাকা ১২০৪
সূচিপত্র
গল্প *সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য *আত্নজা ও একটি করবী গাছ *জীবন ঘসে আগুন *নামহীন গোত্রহীন *পাতালে হাসপাতালে *আমরা অপেক্ষা করছি *রোদে যাবো *মা-মেয়ের সংসার *বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প
উপন্যাস *বৃত্তায়ন *আগুন পাখি
প্রবন্ধ *কথা সাহিত্যের কথকথা *অপ্রকাশের ভার *অতলের আঁখি *লেখা
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় একটি নাম হাসান আজিজুল হক। ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান জেলার যবগ্রামে তার জন্ম । নিজের গ্রাম থেকে স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে ওপার-বাংলায় চলে যান। তিনি, দর্শনশাস্ত্রের পড়াশোনার পর অধ্যাপনা করেন সেখানকার কয়েকটি কলেজে। ১৯৭৩ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক, এখন অবসরপ্রাপ্ত। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘকাল অনেক গল্পের স্ৰষ্টা তিনি। গল্প অনেক লিখেছেন, কিন্তু, রহস্যময় কোনো কারণে, উপন্যাস-লেখায় বিশেষ আগ্ৰহ দেখান নি প্ৰতিভাবান এই কথাসাহিত্যিক । এ-বইটি প্ৰকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকসমাজের উৎসুক প্রতীক্ষার যেন অবসান হলো, আমাদের হাতে এসে পৌঁছল হাসান আজিজুল হকের হৃদয়স্পশী এই উপন্যাস : ’আগুনপাখি’ ।