ভূমিকা একদিন, তরুণ বয়সে, স্বপ্নতাড়িতের মতন এসে যোগ দিয়েছলাম শিক্ষকতায়।প্রতিটা শিরা-ধমনিকে সেদিন যা কামড়ে ধরেছিল তা এক উদ্ধাররহিত স্বপ্ন-সমৃদ্ধ মানুষ গড়ে তোলায় অংশ নেবার স্বপ্ন-সেইসব মানুষ যারা একদিন জাতির জীবনে পালাবদল ঘটাবে। আমার সে স্বপ্ন সফল হয়নি। গত চার দশকে, জাতীয় জীবনের সামগ্রিক অবক্ষয়ের হাত ধরে, আমাদের শিক্ষাঙ্গন ধীরে ধীরে এমন এক নির্বীজ মৃত্যুর শিকারে পরিণত হয়েছিল যে সম্পন্ন বা মহৎ কোনোকিছুর জন্মই সেখানে কার্যত অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এই বিশাল পতনের মুখে কোনো একক ব্যক্তির আলাদাভাবে কিছু করার ছিল না। আমার পক্ষেও তা সম্ভব হয়নি।আমার এই বই আমাদের সম্পন্ন শিক্ষাঙ্গনের নীরক্ত মাঠে অবসিত হবার গ্রুপ।
গত চার দশকে আমাদের শিক্ষাঙ্গন কী করে ধীরে ধীরে এক নিঃসাড় বন্ধ্যাত্বের শিকার হল, কী করে নানা দিক থেকে তার সবুজ ভাঁড়ার মৃত্যুর পদপাতে ঊষার হয়ে উঠল, এই বইয়ে সেই কাহিনী বলার চেষ্টা করেছি। আমাদের শিক্ষাঙ্গণ এই যুগে কতটা বিশৃঙ্খল আর অরাজক হয়ে পড়েছিল এই বই তারই একটা অবিন্যস্ত ও প্রাথমিক দলিল।
শিক্ষাঙ্গনের এই নিঃস্বতা সবকিছুর মতো আমার শিক্ষতার স্বপ্নকেও অর্থহীন করে দিয়েছিল। এই ক্ষেত্রের নিষ্পত্রতার পাশাপাশি আমার ব্যর্থ জীবনের দীর্ঘশ্বাস এই বইয়ে কমবেশি অনুরণিত হয়েছে। বইট এ-যুগের শিক্ষা-ব্যাপারে আগ্রহী পাঠকদের কৌতূহলকে সামান্যতম মেটাতে পারলেও শ্রম সার্থক হল মনে করব। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৮.০২.১৯৯৯
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।