"সেরা বারো ভূতের গল্প"বইটির প্রথমের কিছু অংশ: একদিন অবাক হয়ে দেখি সােনা আমাদের বাগানে বসে আছে। বিকেলবেলা। আমাদের মফস্বল শহরে মাঘ গিয়ে ফারুন পড়েছে। বিকেলবেলা সূর্যের শেষ আলােয় বড় সুন্দর দেখায় শহরটি। অদূরে নদী, নদীর তীর জুড়ে ধুধু বালিয়াড়ি। বহুদূরে নদীর চরে ফাল্গুন মাসের বিকেলবেলায়ও পাতলা একটা কুয়াশার রেখা পড়ে। একটা দুটো গাঙচিল অনবরত নদীর ওপর চক্কর খায়, জলে ঝাপিয়ে পড়ে চেলামাছ তুলে নেয় ঠোটে। আর আছে নৌকা। কত রকমের যে! মহাজনী (নৗকা, পানসি নৌকা, জেলে নৌকা, কেরায়া নৌকা। অনবরত পুবে যায় নৌকা, পশ্চিমে যায়। সােনাকে প্রথম দেখি আমি। হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে হাসুহেনা ঝােপটার কাছে। আমি তখন খেলতে যাচ্ছিলাম মাঠে। সােনাকে দেখেই খেলার কথা ভুলে যাই। দৌড়ে বাগানে গিয়ে ঢুকি। তার আগে চেঁচিয়ে সারাবাড়ি মাত করে ফেলি। সােনা এসেছে। সােনা এসেছে। * সােনা আমাদের কাজের ছেলে। আমার বয়সী। দশ-বারাে বছর হবে। খুব ছােটবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে আছে সােনা। বাবা ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। আমার বাবা থানার বড় দারােগা। আগে ছিলেন বরিশালের পিরােজপুর থানায়। সেখানেই একদিন এক ঝােপের ধারে পাঁচ বছরের সােনাকে কুড়িয়ে পান। গায়ে প্রচণ্ড জ্বল ছিল সােনার। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল ঝােপঝাড়ের ধারে। বাবা গিয়েছিলেন ডাকাত ধরতে। ফেরার পথে সােনাকে ওই অবস্থায় দেখে সেপাইদের কাঁধে চড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। তারপর ডাক্তার-কবরেজ দেখিয়ে পনের দিনে পুরােপুরি সারিয়ে তােলেন সােনাকে। ভালাে হয়ে সােনা কিন্তু তার মা-বাবার কথা, বাড়িঘরের কথা কিছুই বলতে পারে নি। কেবল নিজের নামটা বলতে পেরেছিল। বাবা পরে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, পাঁচ বছরের একটা ছেলে পাওয়া গেছে। নাম সােনা। হালকা-পাতলা গড়ন, গায়ের রং কালাে। যার ছেলে সে এসে ছেলেটিকে যেন নিয়ে যায়। সত্যি সােনার গায়ের রঙ পাকা জামের মতন কালাে। কিন্তু সােনার চেহারাটা ভারি সুন্দর। আমাদের এই শহরের সবাই সােনাকে কালাে মানিক বলে ডাকে। তাে সােনাকে কেউ কিন্তু ফিরিয়ে নিতে এল না। অনেককাল কেটে গেল। সােনা রয়ে গেল আমাদের বাড়িতেই। কাজ-কাম করে, খায়-দায়, ঘুরে বেড়ায়। আমার বয়সী বলে সােনার সঙ্গে আমার ভারি একটা ভাব হয়ে যায়। আমি যেখানে যাই সােনাকে নিয়ে যাই, যা খাই সোেনাকে খাওয়াই। সােনা আমায় ডাকে ছােটভাই বলে। | আমার চেঁচামেচিতে ততক্ষণে বাগানে ছুটে এসেছে সবাই। মা, বাবা, ভাইয়া আর আমাদের বাড়ির অন্যান্য সব লােকজন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে সােনা কোথায় ছিলি এতদিন?’ সােনা কথা বলে না। হাঁটতে মাথা গুজে আগের মতােই বসে থাকে। মা জিগগেস করলেন, কোথায় ছিলি একদিন? বাড়ি আসিসনি কেন? সােনা কথা বলে না। ভাইয়া বললেন, ‘সােনা, কথা বলছিস না কেন রে?” সােনা বসেই থাকে। কথা বলে না, মাথা তােলে না, কারও দিকে তাকায়ও না।