ফ্ল্যাপে লিখা কথা হুমায়ূন এবং আমি ‘মনে এলো ধারায়’ এঁকে যাওয়া বরেণ্য লেখকের রেখাচিত্র মাত্র। একে অন্তরঙ্গ স্মৃতির ‘আলোকে হুমায়ূন আহমেদ’ বলেও গণ্য করা যায়। চার দশকের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যের স্মৃতি আলো ফেলেছে হুমায়ূন আহমেদের কর্ম ও জীবন-চর্যার আলো-আঁধারিতে।
হুমায়ূনকে নিয়ে জিজ্ঞাসার শেষ নাই। কিন্তু জিজ্ঞাসার জবাব ধরা থাকলো এই স্মৃতিচারণের বর্ণনা আর তার ফাঁক-ফোকরে। জীবনী এ নয়, তবে জীবনীর কিছু উপাদান এতে বিধৃত আছে, এ কথা অনস্বীকার্য।
ভূমিকা চোখ যার নাগাল পায় না, মন তাকে খুঁজে বেড়ায়। এই খুঁজে বেড়ানোরই পরিনতি- ‘হুমায়ূন এবং আমি’ হুমায়ূনকে আর কাছে পাওয়ার উপায় নাই। আজ তাই স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোই সার। এ ভাবেই তাকে নিজের মাঝে অনুভব করি। দীর্ঘ দিনের সান্নিধ্যের স্মৃতি তাকে কাছে এনে দেয়।
এই দেখাকে শব্দে ধরে রাখার পেছনে বাইরের একটা তাগিদও ছিল। হুমায়ূন আহমেদ আর তার অনুপম সৃষ্টিরাজি নিয়ে লেখালেখি করে আসছি চার দশক ধরে। হুমায়ূন চলে যাওয়ার পর তাগিদ আসতে থাকে বিক্ষিপ্ত এই লেখাগুলো গ্রান্থিত করে তোলার। আমি সে পথে না গিয়ে স্মৃতি আলোকে তার একটা ছবি তোলার পথই বেছে নিই। এ নেহাতই মনে এলো ধারায় এঁকে যাওয়া রেখাচিত্র মাত্র। তার বর্ণাঢ্য জীবনের পরিপূর্ণ চিত্র নয়। আমি যা এবং যেভাবে দেখেছি তাই বলে গেছি। সর্বত্র ঘটনাক্রমও মেনে চলিনি। সন্দেহ নাই, জীবনীর কিছু উপাদার এতে আছে। তবে এ জীবনী নয়।
আমার স্মৃতি নির্ভর করে হুমায়ূন আহমেদের গল্প বলেছি। স্মৃতিচরণে কথকের বড় হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা থাকেই। আমি সচেতন ভাবে এ ফাঁদ এড়ানোর চেষ্টা করেছি। কথক যেখানে মূল কথার সঙ্গে সম্পৃক্ত তার কিছু উপস্থিতি অনিবার্য। ফলে হুমায়ূন কথা উপজীব্য হলেও আমিও তাতে কমবেশি জড়িয়ে পড়েছি। নামাকরণেই তার সকীকৃতি থাকলো।
হুমায়ূন আমার কি এবং কতটুকু ছিলেন, বলে বোঝানের ক্ষমতা আমার নই। দরকারও নাই তার। হুমায়ূন কি এবং কেমন ছিলেন তার কিছু আভাস যদি দিয়ে তাকতে পারি, তাই হবে আমার পরম তৃপ্তি। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রতিনিয়ত হুমায়ূনকে নিয়ে আমাকে যেসব প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয় তার নিরসনের জন্যেও এ বইটি লেখার প্রয়োজন ছিল। অন্তত আমার দিক থেকে।
হুমায়ূন আহমেদ আমাকে ‘নানাজি’ ডাকতেন। দেখতেন শ্রদ্ধার চোখে। আমি তাকে অনুজের মতো মমতায় গ্রহণ করলেও স্রষ্টা হুমায়ূনকে দেখতাম সম্মানের দৃষ্টিতে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের এই দ্বৈততা-ছাপ ফেলেছে হুমায়ূন এবং আমির পাতায় পাতায়। সাধারণ বর্ণনায় যেখানে সম্মাণ সূচক বললেন- করলেন লিখেছি সরাসরি সংলাপে এসেছে আমাদের মধ্যে চালু ‘তুমি’। বাস্তবতার এ অনুসৃতি রসভঙ্গের কারণ ঘটাবে না বলেই মনে করি। আটপৌরে আলাপের মতো হুমায়ূন কথা বলে গেছি। কোথাও রঙ চড়ানের চেষ্টা করিনি। ঢালাও বর্ণনার চাইতে নিজেকে ইঙ্গিতময়তায় আটকে রাখার চেষ্টা করেছি। হুমায়ূনের মতো আমিও পাঠকের মেধায় আস্থাশীল।
‘হুমায়ূন এবং আমি’ সম্পর্কে একটি ব্যতিক্রমী তথ্য হলো এই, বইটি দেখা হয় এক প্রকাশনীর তাগিদে, কম্পোজ হয় অন্য প্রকাশনীতে; আর শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হচ্ছে অন্য জায়গা থেকে। এ উপলক্ষ্যে আমি জ্ঞানকোষ-এর নাজমুল ওহাব, মাওলা ব্রাদার্সের মাহমুদ এবং ওয়াহিদ ইবনে রেজা বাপ্পির কাছে কৃতজ্ঞ। ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে তাদের সহযোগিতাই আলস্য করেছে।
অন্বেষার প্রকাশক শাহাদাত হোসেন বাংলাবাজার আর উত্তরায় ছোটাছুটি করে যেভাবে ‘হুমায়ুন এবং আমি’ প্র প্রকাশনা সম্ভব করলেন সে জন্যে আমি তার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।
কয়েক মাস আগে দেখা হলে শিল্পী ধ্রুব এষ-কে প্রচ্ছদের কথা বলেছিলাম। তারপর ফোনেও যোগাযোগ করতে পারিনি। প্রকাশকের কাছ থেকে শুনলাম ধ্রুব প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন। না দেখেই ওটা ছেপে দিতে বলে দিলাম।
ছবির জন্য প্রধানত পারিবারিক সংগ্রহের উপর নির্ভর করেছি। প্রখ্যাত আলোচিত্র শিল্পী নাসির আলী মামুন দিয়েছেন একটি ছবি। এ ছাড়া কয়েকটি ছবি পেয়েছি দেশ টিভি এবং অন্যদিন থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে আমার ধন্যবাদ।
চল্লিশ বছরের স্মৃতি একটানা বলে শেষ করার নয়। যা বাকি থাকলো তার কথা পরে ভাবা যাবে, যদি অদৌ তার প্রয়োজন অনুভূত হয়।
Saleh Choudhury সালেহ চৌধুরী সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা। জন্ম ২৫ কাৰ্তিক, ১৩৪৩ (১১ নভেম্বর, ১৯৩৬)। সুনামগঞ্জ জেলার গচিয়া গ্রামে। লেখাপড়া-নিজ গ্রাম, মৌলবী বাজার, সিলেট এবং লাহাের। স্ত্রী-শাহেরা চৌধুরী। তিন ছেলের পিতা। লেখালেখি, আঁকিবুকি, কাটুম-কুটুম আর দাবা-বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহী। বই পড়া প্রধান বিনোদন। শামসুর রাহমান আর হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জীবনের অন্যতম সন্তোষ!