‘আলবদর এক বিস্ময়!' ১৯৭১ সালে মানবতাবিরােধী অপরাধে দায়ী জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম প্রশংসা করে লিখেছিল। সত্যিই ছিল তারা ‘বিস্ময়। পৃথিবীর জঘন্যতম খুনি হিসেবে আলবদররা ইতিহাসে তাদের স্থান করে নিয়েছে। ১৯৭১ সালে এক বিদেশী সাংবাদিক রায়ের বাজার বধ্যভূমি দেখে আলবদরদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, এরা মনুষ্যপদবাচ্য নয়। আলবদররা মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। গণহত্যা, ধর্ষণে অংশ নিয়েছে। নির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। জামায়াতে ইসলামীর সহযােগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের রূপান্তরিত হয়েছিল আলবদর বাহিনী। আলবদর বিশেষজ্ঞ পাকিস্তানের মনসুর খালেদ লিখেছেন, এদের সংখ্যাছিল ৭৩ হাজার। ছাত্র সংঘের সদস্য ছাড়াও অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেকেই যােগ দিয়েছিল আলবদর বাহিনীতে। এদের প্রধান ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী। উপ-প্রধান ছিলেন আলী আহসান মুজাহিদ। কাদের মােলা, কামরুজ্জামান-এরাও ছিলেন আলবদরদের নেতা। মানবতা বিরােধী অপরাধের দায়ে এখন তাদের বিচার চলছে। আলবদরদের ইতিহাস এতদিন ছিল রহস্যাবৃত। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঐতিহাসিক ড. মুনতাসীর মামুন সেই রহস্য উম্মােচন করেছেন। আলবদরদের উত্থান, কীর্তিকাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন এই গ্রন্থে। বাংলা ভাষার আলবদরদের সম্পর্কে প্রথম বই আলবদর ১৯৭১। ইতিহাস পাঠ যে কতাে রােমাঞ্চকর-এই গ্রন্থ পাঠে তা বােঝা যাবে।
মুনতাসীর মামুনের পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার গুলবাহার গ্রামে, কিন্তু তিনি ঢাকার ইসলামপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। সেখানেই পোর্ট ট্রাস্ট প্রাইমারি ও হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নেন। পরে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন এবং একই বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবনে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন, কাজ করেছেন ‘দৈনিক বাংলা বিচিত্রা’য়। এছাড়াও স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনের সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৪ সালে প্রভাষক পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপরই তার বিভিন্ন অনুবাদগ্রন্থ, চিত্র সমালোচনা এবং ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ইতিহাসের প্রতি তার ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট' প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার ইতিহাসকে তিনি প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান- এই উদ্দেশ্যেই মুনতাসীর মামুনের বই লেখা। একজন শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক। ঢাকা শহর নিয়ে তার রয়েছে গবেষণাপত্র। গড়ে তুলেছেন ‘সেন্টার ফর ঢাকা স্টাডিজ’ নামের ইতিহাস চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে মুনতাসীর মামুন এর বই সমগ্র তথা ১২টি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মননশীল এই লেখক দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে লিখে যাচ্ছেন নানা বিষয়ে। মুনতাসীর মামুন এর বই সমূহ এর বিষয় বহুমাত্রিক। তার গ্রন্থের সংখ্যা ২২০, যাতে স্থান পেয়েছে গল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা এবং অনুবাদ সাহিত্য। শিশু-কিশোরদের নিয়েও তার লেখা গ্রন্থ প্রশংসা কুড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তার সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বর্তমানে এই ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।