কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বিদ্রোহী কবি হিসেবে অভিহিত হলেও নজরুলের নিজের ভাষ্য থেকেই আমরা পাই যে, তিনি প্রেম দিতে এসেছিলেন এবং প্রেম পেতে এসেছিলেন। নজরুল ভাষ্য: আমার কাব্য অস্তিত্বের পনের আনাই স্বপ্নে বিভোর ও সৃষ্টিশীলতার ব্যথায় ডগমগ; অথচ শিল্পীচিত্তের মাত্র এক আনা পলিটিক্স করেছে, বক্তৃতা দিয়েছে এবং সংঘ-সংগঠন গড়েছে। ১৯১৯ সনের নজরুল সাহিত্যাদর্শকে অবলোকন করলে আমরা দেখবো: তখন লেখক হবার ইচ্ছা তাঁর প্রচণ্ডভাবে জাগ্রত হয়েছে। প্রকৃতি প্রবণতা এবং দর্শন ও ঘ্রাণেন্দ্রিয় সচেতনতার মাধ্যমে কবি প্রকৃত কবি হয়ে উঠেন। প্রেমিকমনের অনুভবই সৃষ্টিকে সম্ভব করে তোলে। মৃত্তিকালগ্নতা নজরুলকে লেখায় প্রণোদিত করেছে। বাঙালি ও বিশ্ববাসীকে জানানোর আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁর লেখক-সত্তার জাগরণ। ১৯২০-২১ সালে নজরুল সাহিত্যাদর্শে আমরা তাঁকে পরের ব্যথায় ব্যথিত হতে দেখি। বিশ্বজনের ব্যথা নিজের করে নিতে পারলে আত্মা উন্নত হয় বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। সত্যকে চিনলে ও সুন্দরকে উপলব্ধি করতে পারলেই পরের ত্যাগে আনন্দ পাওয়া যায়। জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের আকাঙ্ক্ষা তিনি পোষণ করেছেন। লেখার মধ্যে সংকীর্ণতা, ভণ্ডামি
রহমান হাবিব-এর ‘আল মুজাহিদী: মৃত্তিকার কবি গ্রন্থটি হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসঐতিহ্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-নৃতত্ত-রাজনীতি ও সমাজ - প্রভৃতি বিষয়ের প্রজ্ঞাগত সংশ্লেষণকে সামগ্রিকতার দর্শন হিসেবে মূল্যায়নের প্রয়াস। উল্লেখ্য যে, বাঙালির কাব্যদর্শনভাবনার অনুচিন্তনকে উভয়বঙ্গে এভাবে কেউ ইতিপূর্বে আলােকপাত করেননি। কবিতার আবেগ, অনুভূতি, প্রেম ও নিসর্গচেতনার সঙ্গে জীবনের বহুরৈখিক বিষয়ব্যাপ্তির প্রাজ্ঞতার দর্শনকে এ গ্রন্থে নবতর দৃষ্টিতে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে । চর্যাপদের কবিতা থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কবিতাসহ উনিশ শতকের আধুনিক কবিতার পথ-পরিক্রমা পার হয়ে বিশ শতকের ত্রিশের দশকের বৈশ্বিক কাব্যচেতনামূলক কবিতাসমেত বাংলাদেশের চল্লিশ থেকে আশির দশকের কবিতাসহ গত শতাব্দীর নব্বই দশকের কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখাভিত্তিক পর্যালােচনা সম্পৃক্ত জীবনের বহুমুখী প্রজ্ঞাচেতনার সামূহিকতার দর্শনকে এ গ্রন্থে পর্যবেক্ষণ করা কয়েছে । ষাটের দশকের কবি আল মুজাহিদীর কবিতায় মৃত্তিকা, স্বদেশ, নারীচেতনা, সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্ববােধ, নান্দনিকতা, নৈতিকতা, ইহলৌকিকতা এবং স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসসহ সত্যের প্রতি অবিচলতা এবং মানবের সম্ভাবনার প্রতি ইতিবাচক আশ্বস্ততা অভিব্যক্ত হয়েছে। তাঁর কবিতার সে দৃষ্টিভঙ্গিসমূহকে দর্শনভাবনার সম্পৃক্ততায় এ গ্রন্থে নিরীক্ষা করা হয়েছে। যে কোন শিল্পীর দর্শন মূলত মৃত্তিকা ও মানবকে কেন্দ্র করেই বিনির্মিত হয় । কবি আল মুজাহিদীর কবিতার দর্শন মৃত্তিকানির্ভর বলেই গ্রন্থের উপযুক্ত নামকরণ।