কবি নির্মলেন্দু গুণ-এর আত্মজীবনী গ্রন্থ মহাজীবনের কাব্য। এখানে স্থান পেয়েছে গুণের লেখা- "আমার ছেলেবেলা", "আমার কন্ঠস্বর", "আত্মকথা ১৯৭১" এবং "রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫"। রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫-লেখাটি এখন পর্যন্ত রচিত গুণের স্বর্ণজীবনের এক অখন্ড সংস্করণ। এসব লেখা নিয়েই এবারের বইমলোয় আসলো তাঁর মহাজীবনের কাব্য। মূলত ১৯৪৫-১৯৭৫ এই ঘটনাবহুল সময়খন্ডই উঠে এসেছে এ আত্মজীবনী গ্রন্থে। এর মধ্যে বাঙ্গালি জীবনের সবচেয়ে সুবর্ণসময় ১৯৬৫-১৯৭৫ স্থান পেয়েছে সুচারুভাবে। কথা প্রকাশ বইটি বের করেছে। প্রচ্ছদ একেঁছেন ধ্রুব এষ। আমার কণ্ঠস্বর আত্মস্মৃতিমূলক বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব কণ্ঠস্বর- আন্তরিক, আদর্শের ও প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বে উদ্ভ্রান্ত, শক্তিশালী, সাহসী, সৎ ও সংরক্ত। বহু দিক থেকেই নির্মলেন্দু গুণের 'আমার কণ্ঠস্বর' অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জাঁ জাক রুশোর স্বীকারোক্তি নামক বিশ্বখ্যাত গ্রন্থের সঙ্গে তুললীয়। এ গ্রন্থ মানবিক অস্তিত্বের এমন এক বহুমাত্রিক প্রকাশ, যা একাধারে নাটকীয় ও মর্মস্পর্শী। কলকাতার দেশ পত্রিকায় কথাগুলো লিখেছিলেন কবি-প্রাবন্ধিক শ্রীসুরজিৎ দাশগুপ্ত। যার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনীর চারিত্রটি। নির্মলেন্দু গুণ সত্যসন্ধানী, স্বীকারোক্তিমূলক সাহিত্যধারার লেখক। তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ১৯৭০ সালে 'প্রেমাংশুর রক্ত চাই' কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে যাঁর লেখার আত্মপ্রকাশ। নির্মলেন্দু গুণের কবি হয়ে ওঠা, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠা এবং শেখ মুজিবুরের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা- পরস্পরের হাত ধরে অগ্রসর হওয়া এই তিনটি প্রতিপাদ্যই এই আত্মজীবনীতে বর্ণিত হয়েছে। এই আত্মজীবনী আমাদের ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিলও বটে। তাঁর জন্মের দুই বছরের মাথায় দেশভাগ; তারপর বাঙালির স্বাধিকার চেতনার প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, উত্তাল ঊনসত্তর। তারপর বাঙালি জাতির সবচেয়ে মর্মান্তিক ও শোকবহ ঘটনা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়া। এই যে বিপুল ঘটনাবহুল ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ সময়কাল, এ যেন কবিরই সমান বয়সী। এই উজ্জ্বল সময়খণ্ডই উঠে এসেছে তাঁর চার পর্বের আত্মজীবনীতে। যার মধ্যে রয়েছে বাঙালির সবচেয়ে সুবর্ণসময় ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫। ১৫ আগস্ট সম্পর্কে ভারতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ভারত বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে কোনো ভূমিকা রাখেনি; আবার খালেদ মোশাররফকে বাঁচানোর জন্যও কোনো ভূমিকা রাখেনি। অথচ ভারত জুজুর ভয় দেখিয়েই খালেদের বারোটা বাজিয়ে দিতে সক্ষম হয় খালেদের বিরুদ্ধবাদীরা। কিন্তু আমাদের সমগ্র সত্তাকে কাঁপিয়ে দিয়ে বিগত বিনিদ্র প্রায় রজনীর সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৭ নভেম্বরের ভোর আসে। পিলখানার ভেতর থেকে রাইফেলের গুলি ছুড়তে ছুড়তে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাপূর্ণ স্লোগান ছড়িয়ে বেরিয়ে আসে জওয়ানরা। তাদের কণ্ঠে 'নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর' ধ্বনি। পুরো আজিমপুর জেগে ওঠে উল্লাসে। সেই উল্লাস সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে পরাজিত জেনারেল খালেদের হাত থেকে জেনারেল জিয়ার ক্ষমতা উদ্ধারের সংবাদ। মোশতাকসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যে দূরত্ব বজায় ছিল, তা ৭ নভেম্বরে সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুচে যায়। এভাবে তাঁর লেখা প্রতিটি লাইনে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। প্রাচীন গ্রিক ভাষার দার্শনিক হাইপেশিয়া, যার মধ্যে অসাধারণ বাগ্মিতা, বিনয় এবং সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটেছিল। এই বইয়ের প্রতিটি লেখায় তেমনি সূক্ষ্ম ও গভীর দার্শনিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। কিন্তু হাইপেশিয়ার মতো কোনো গাণিতিক ধারণার প্রয়োজন না পড়লেও এই বইয়ে ১৯৬০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক ও সামরিক হিসাব-নিকাশ ছিল, তা গাণিতিক ধারণার বাইরেও নতুন হিসাবের রূপরেখা তৈরি করে। ফলে 'মহাজীবনের কাব্য'- কবির, বাংলাদেশের এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আত্মস্বীকারোক্তির অনবদ্য দলিল।
জন্ম: জুন ২১, ১৯৪৫, আষাঢ় ৭, ১৩৫২ বঙ্গাব্দ, যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত,তিনি একজন বাংলাদেশী কবি এবং চিত্রশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। তাঁর কবিতায় মূলত নারীপ্রেম, শ্রেণি-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধীতা, এ-বিষয়সমূহ প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জরপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমী , ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন।