ফ্ল্যাপে লিখা কথা এক অচেনা অন্তরীণ মুক্তিযোদ্ধার কারাগারে ছাপ্পান্ন দিনের জীবনলেখ্য এটি। গ্রামের একজন অতি সাধারণ স্বাধীনচেতা বেসরকারি স্কুল শিক্ষকের মুক্তিযুদ্ধকালীন কারাবরণের (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১-২৩ নভেম্বর ১৯৭১) সংক্ষিপ্ত বিবরণ অনবদ্যভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে বইটিতে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দ্বারা অত্যাচারিত, অবহেলিত, পদদলিত ও বঞ্চিত নিরীহ গ্রামবাংলার মানুষের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিচ্ছবি বিইটিতে ফুটে উঠেছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় (একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে) মুক্তিপাগল প্রতিটি নাগরিকদের মতো বিদ্যালয় কর্ম ত্যাগ করে নিজস্ব ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে দিক নিদের্শনা, থাকা-খাওয়ার যোগান, সময়ে সময়ে বিভিন্ন তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানো ছিল লেখকের প্রাত্যহিক কর্ম। সেই সঙ্গে ছিল পরিবার, সন্তান, প্রতিবেশীদের রক্ষার দায়িত্ব। পরিবার ও জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দেশেল স্বাধীনতার জন্য নিজেকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকলেও না- পাক বাহিনীর সাথে সাথে দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর অত্যাচারে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব হয়নি। সহ্য করতে হয়েছে দেশীয় রাজাকার ইবলিশদের উপহাস আর মানবরূপী না-পাক বাহিনীর অমানুষিক নিষ্ঠুর আক্রমণ। করতে হয়েছে কারাবরণ। দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে যেয়ে-রাজদ্রোহী হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে কারাবরণ আর বর্বর পাশবিক নির্যাতন। দু’হাত পিছনে বেঁধে ইচ্ছেমতো চলত বুটের লাথি আর বেত্রাঘাত। তৃষ্ণায় প্রাণ ফেটে গেলে জুটত পানির বদলে প্রস্রাব মিশ্রিত পানি। বেত্রাঘাতের পর রক্তাক্ত শরীরে নবপশুরা ঢেলে দিত লবন। কখনও আবার লোহার শিখ গরম করে গায়ে স্পর্শ করানো হতো। পরনের সাদা আরবীয় পোশাক রক্তাক্ত হয়ে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকত। পরক্ষনে আবার দু’পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে দড়ি বেঁধে উল্টা করে ঝুলিয়ে চলত মানবরূপ পশুদের নির্যাতন।
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও দেশকে মুক্ত করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন সকল কারাবাসী। মরণকে তুচ্ছ জ্ঞান করে শেষ প্রহারটি পর্যন্ত মুখে উচ্চারিত হয়েছে জয় বাংলা। চোখের সামনে কত মৃত্যু! কত ছুঁড়ে ফেলা লাশ! কারাগারের চারপাশে মা-বোনদের নিয়ে চলত দেশীয় রাজাকার ও না-পাক সেনাদের বলপূর্বক পাশবিক অত্যাচার। পাশবিক অত্যাচারের শেষপ্রান্তে চলত গুলি করে হত্যা। কারাবাসীদের প্রাত্যহিক জীবন ছিল এমনই হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী। খাবার তালিকায় ছিল ঝাল-লবণবিহীন কচু ও ক্ষীরাই-এর তরল তরকারি। প্রহারক্লিষ্ট শরীরের বেদনা ও দুর্বলতায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আরো অনেক অমানুষিক নিষ্ঠুর প্রতিকূলতা সহ্য করতে হয়েছে। সেই নিষ্ঠুর কারাবরণ থেকে লেখকের বেঁচে ফিরে আসা ছিল অলৌকিক ও মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ কৃপা।