"বাছাই গল্প" বইয়ের ফ্ল্যাপের কথা: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্রে রেখে- ছােটগল্পে এর নিষ্ঠ রূপকার মঈনুল আহসান সাবের। কিন্তু একথা একবাক্যে বলায় অনেকটাই না বলা থেকে যায় এই জন্যে, নাগরিক সমাজ, নাগরিক ক্লান্তি ও হতাশা, গ্রামীণ জনপদকে আত্মসাৎ করে আর বাসিন্দাদের শ্রম আর ঘামকে শােষণ করে শনৈঃশনৈঃ বেড়ে উঠেছে যে নগর- সেই জীবনে। অবসাদ ক্লান্তি হতাশা যেমন লতিয়ে পেঁচিয়ে থাকে পাশাপাশি এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায় নাগরিক মানুষের বিবিধ। বঞ্চনা ও হঠকারিতা, প্রবঞ্চনা ও শঠতা। মঈনুল আহসান সাবের গত চার দশক ধরে গল্পে সে কথা আমাদের জানিয়েছেন। জানিয়েছেন, নাগরিক জীবনের স্তরে স্তরে পংকিলতা, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিতের সঙ্গে ‘জয়ী’র সহযাত্রা, মুক্তিযুদ্ধই যেন সেখানে এক মােক্ষম ব্যবসাযােগ্য উপাদান, জানিয়েছেন নাগরিক ক্লান্তির ভিতরে ব্যক্তির সমাজ-বিচ্ছিন্নতার গল্প। এদিকে নগরে সৃষ্টি হয়েছে। নারী-পুরুষের সম্পর্কের নতুন মাত্রা যা আগের প্রায় স্থবির ও জটিলতাহীন সমাজে ছিল প্রায় অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্বও বটে। পাশাপাশি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের এক মােক্ষক ব্যবস্থা। সেখানে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্র কখনও কখনও এমনভাবে ঢুকে পড়ে যে ব্যক্তি আর ব্যক্তি থাকে না, তার মাথা কোনওভাবে উঁচু হয় না অথবা উঁচু করতে পারে না। পরাজিত সে মানুষ, অর্থবিত্তে পঙ্গু সে মানুষ। অথচ তার সামনেই ফুলে-উঠল প্রতিবেশী সে জানে না এই বিত্ত আর প্রতিপত্তি কীভাবে তার সামনে এসে হাজির, এত সাফল্য তার হাতে এখন আর কোনও ভাবে আঁটছে না। রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে আমাদের সামনে ভুশ করে ভেসে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে মানুষের চেহারায় বিকৃত দানব। একটু দূর থেকে দেখলেই দেখা যায় মানুষটা আর মানুষ নেই, কাছে যেয়ে চোখে আতশ কাচ ধরার দরকার পড়ে না, খালি চোখই যথেষ্ট। মঈনুল আহসান সাবের এই খালি চোখের দেখাটাই স্পষ্ট করেন বারবার। চোখ কোঁচকালে কি এক চোখ বুজে এইসবই আমরা নিত্য পরিষ্কার দেখি, এমনকি চোখ বুজেও দেখি একেবারে । নির্মেদ মিতব্যয়ী আর নির্মোহ গল্পভাষায়। সাবেরের কলমের গল্পাঠ তাই প্রায় চার দর্শকের ক্রম পরিবর্তনশীল বাংলাদেশকে খুব কাছে থেকে দেখা।
মঈনুল আহসান সাবেরের জন্ম ঢাকায়। ২৬ মে ১৯৫৮। পৈতৃক ভিটে একদা বরিশাল ভাগ হয়ে যাওয়ার পর পিরােজপুর। দেশের বহু বহু জায়গায় যাওয়া হয়েছে, যাওয়া হয়নি ওই পিরােজপুর। বাবার ফেলে আসা ভূমি সাজানাে আছে সাবেরের কল্পনায়। জন্মের পর এই ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। সংসার জীবনও। যদিও এক সময় ইচ্ছা ছিল, থিতু হবেন না, পথে পথে থাকবেন, আজ এখানে তাে কাল ওখানে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তিনিও সেই ওদের মতাে, যাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত না টেনেছে, তার চেয়ে বেশি টেনেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চত্বর। বড়দের জন্য প্রথম লেখা ১৯৭৪-এ। প্রকাশিত হয়েছিলাে সে সময়কার সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। তারপর ৪০ বছর ধরে এই একটিই কাজ, বিরতিসহ বিরতি ছাড়া। প্রথম বই গ্রল্পগ্রন্থ “পরাস্ত সহিস বেরিয়েছিল ১৯৮২ সালে। চাকরি না করে উপায় নেই। তাই করছেন, সাংবাদিকতা। এখন অবশ্য বেকার। বেকার থাকার অভিজ্ঞতা তার আছে। বাসনা বেকারই থেকে যাওয়ার। বেড়াতে ভালােবাসেন। একা থাকতেও পুরস্কার পেয়েছেন সামান্য কয়েকটি। বাপি শাহরিয়ার শিশুসাহিত্য পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। স্ত্রী নাহিদ নিগার, দু পুত্র আহসান সেনান ও আহসান সাজিদকে নিয়ে তার সংসার।