ভূমিকা আবহমান কাল থেকে মানব সমাজে জ্ঞানের চর্চাটা ছিলো সমষ্টিগত -- দুর্গম প্রকৃতির সাথে লড়াই করে সভ্যতা গড়ে তোলার পথে অর্জিত জ্ঞানটুকুতে ছিলো সবার অধিকার। কিন্তু কালের বিবর্তনের ধারায় এক সময় জ্ঞান হয়ে পড়ে বন্দী, মুষ্টিমেয় অল্প কিছু মানুষেরই কেবল থাকে এই জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের সুযোগ। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে বিশ্বের সব জ্ঞান-বিজ্ঞান পৌছে দেয়ার যে মাধ্যম বিশ্বকোষ - আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক কারণে জনমানুষের কাছে তা হয়ে পড়েছিলো অধরা। অচলায়তনের এই নিগড় ভাঙতে ২০০১ সালে জন্ম নিয়েছিলো এক নতুন ধারার বিশ্বকোষ - উইকিপিডিয়া। জনমানুষের লব্ধ জ্ঞানকে জনমানুষের হাতেই তিল তিল করে সঞ্চিত করে জ্ঞানের মহাসাগর গড়ে তোলাই - এই ছিলো উইকিপিডিয়ার মূলমন্ত্র। প্রতিষ্ঠার পর ১ যুগের মধ্যেই উইকিপিডিয়া পরিণত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম জ্ঞানভাণ্ডারে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ জ্ঞান পিপাসু স্বেচ্ছাসেবীর হাতে গড়ে তোলা এই জ্ঞানভাণ্ডারে স্থান পেয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, প্রযুক্তি, রাজনীতি, থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সব বিষয়। আর তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে এই জ্ঞান হয়ে পড়েছে সবার জন্য উন্মুক্ত, বিশ্বের সর্বত্র পৌছে গেছে উইকিপিডিয়ার সুফল। আজ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কিশোর শিার্থীটি মুঠোফোনের কয়েকটি বোতাম চেপেই হাতের নাগালে পাচ্ছে উইকিপিডিয়ার সব তথ্য। ২০১৩ সালের শুরুতে বিশ্বের ২৮৫টি ভাষায় আড়াই কোটি নিবন্ধ রয়েছে উইকিপিডিয়ার নানা সংস্করণে। আর জ্ঞানের এই অবারিত ভাণ্ডার এনে দিয়েছে সারা বিশ্বে এক তথ্যবিপ্লব, জনমানুষের জ্ঞান সবার কাছে পৌছে দিয়েছে এই জনমানুষের বিশ্বকোষ।
গত ৬ বছর ধরে এক ঝাঁক উদ্যমী তরুণ নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলা ভাষার উইকিপিডিয়ার উপরে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে এরাই গড়ে তুলছেন বাংলা ভাষায় একটি মুক্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার। একটা ব্যাপার এখানে ল্যনীয় - বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি -- এসবের কথা সংরণ, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয়া - এই কাজগুলো দায়টা কিন্তু আমাদেরই। বাইরে থেকে কেউ এসে এই কাজটা করবেনা, বরং আমাদেরকেই লিখে যেতে হবে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের কথা। বাংলা উইকিপিডিয়ার উদ্যমী কর্মীরা এই কাজটিই করে চলেছেন, গড়ে তুলছেন বাংলা ভাষার বৃহত্তম জ্ঞানভাণ্ডার। প্রযুক্তিগত সমস্যাসহ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলা উইকিপিডিয়ার এসব উইকিপিডিয়ানেরা এগিয়ে চলেছেন। তাঁদের হাতে লিপিবদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা, আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের কথা, সমৃদ্ধ সংস্কৃতির কথা, আর বিশ্বের তাবত জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা।
উইকিপিডিয়া হলো জনমানুষের বিশ্বকোষ - এটি গড়ে উঠে আপনার আমার মতো মানুষের হাতেই। অল্প কিছু মূলনীতি, প্রতিটি তথ্যের সাথে তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স দেয়া, নিরপেতা বজায় রাখা - এসবের উপরে ভিত্তি করেই উইকিপিডিয়া গড়ে উঠছে। আর এই নিয়মগুলো মেনে যে কেউ উইকিপিডিয়াতে তথ্য যোগ বা সম্পাদনা করতে পারেন -- উইকিপিডিয়ার অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে এটাই রয়েছে। তবে উৎসাহ থাকলেও অনেকেই উইকিপিডিয়াতে লেখার নিয়মগুলো না জানাতে এই মহৎ কাজে অংশ নিতে পারেন না। এই সমস্যার সমাধান করতে সুপ্রিয় নুরুন্নবী চৌধুরী হাছিব এগিয়ে এসেছেন, উইকিপিডিয়ার খুঁটিনাটি সব তথ্য, কীভাবে উইকিপিডিয়াতে সম্পাদনা করা সম্ভব এবং কীভাবে জনমানুষের বিশ্বকোষ গড়ার এই মহাপ্রয়াসে সবাই অংশ নিতে পারেন - এই তথ্যগুলো নিয়ে হাছিব এই বইটি লিখেছেন। বাংলা উইকিপিডিয়ার একনিষ্ঠ কর্মী হাছিব দীর্ঘকাল ধরে উইকিপিডিয়ার উপরে কাজ করছেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক নিবন্ধ তাঁর হাতেই যুক্ত হয়েছে উইকিপিডিয়াতে। আর বাংলাদেশে উইকিপিডিয়ার বিকাশ ও প্রসারে সাংগঠনিক তৎপরতার সাথেও হাছিব জড়িত। হাছিবের লেখা এই চমৎকার বইটিতে হাতে কলমে দেখানো হয়েছে কীভাবে উইকিপিডিয়াতে তথ্য যোগ করতে হয়, লিংক, ছবি এসব দিতে হয়, আর উইকিপিডিয়াতে তথ্য যোগ করার নিয়মাবলীগুলো কী রকম। উইকিপিডিয়াতে কাজ করতে আগ্রহী সবার এই বইটি খুব কাজে লাগবে, আর হাছিবের লেখা এই বইটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে আরো অনেক কর্মী যোগ দিতে পারবেন এই মহাপ্রয়াসে। আগামীর প্রজন্মের কাছে মানব সভ্যতার সব জ্ঞানকে পৌছে দেয়াটা আমাদের কর্তব্য, আর বাংলা ভাষার উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের সব জ্ঞান-বিজ্ঞানকে জনমানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ায় এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস। নুরুন্নবী চৌধুরী হাছিবের এই উদ্যোগে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, আর সেই সাথে এই বইটির পাঠকদের স্বাগতম জানাই বাংলা উইকিপিডিয়ার জগতে, বাংলা ভাষার বিশ্বকোষটি গড়ে উঠবে, সমৃদ্ধ হবে আপনাদের হাতেই। শুভকামনা রইলো।
ড. রাগিব হাসান
সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ
ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম
প্রশাসক ও নীতিনির্ধারক, বাংলা উইকিপিডিয়া
প্রশাসক, ইংরেজি উইকিপিডিয়া
[email protected]