স্বপ্ন, কল্পনা, আশার অসংখ্য শাখা প্রশাখা বিস্তারে ছড়া খুব কার্যকরী। ছড়ার ছন্দের ঝংকার শিশু-কিশোর মনে খুব সহজেই দোলা দেয়। শিশুর কান্না থামাতে, ঘুম পাড়াতে এমনকি খেলতে গেলেও ছড়া দরকার হয়। ছড়ার ভাষা সহজ সরল, কখনো অর্থপূর্ণ আবার কখনো নিরর্থকও। ছড়া সর্ম্পকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেই জন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’ ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই শিশু সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে ছড়া তাঁর নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। ছড়াকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়। যেমন- শিশুতোষ ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, ছড়ার ছন্দাশ্রিত কিশোর কবিতা প্রভৃতি। আলোচিত এ ছড়াগ্রন্থটির ছড়াকার স.ম. শামসুল আলম। শামসুল আলমের ছড়ায় ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে আছে দেশপ্রেমের মন্ত্র। দেশের জন্য যারা যুগে যুগে আত্মদান করেছে তাদেরকে ছড়ায় এনেছেন স্বসম্মানে। তাদেরকে প্রেরণার বাতিঘর করে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় বুনে দেন শিশু-কিশোর মনে। সূর্যকুমার সেন যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত, তার ডাকনাম ছিল কালু, ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং নিজ জীবন উৎসর্গ করেন। সূর্যসেনের বাহিনী কয়েকদিনের জন্যে ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। তাকে নিয়ে স.ম. শামসুল আলম লিখেছেন। ‘মাস্টারদা, তোমার কথা/ভীষণ মনে পড়ে/যখন দেখি অভাগা দেশ কাঁদে।/নিয়ম-নীতি ভাঙার প্রতিবাদে/বিদ্রোহী মন লাফিয়ে ওঠে,/আর থাকি নে ঘরে।/মাস্টারদা, নেই তুমি আজ /কী হয়েছে তাতেÑ/ভেবেছিলাম তোমার অনুসারী/আমরা এ দেশ গড়তে ঠিকই পারি।/কিন্তু ধরা পড়ে আছি/বাজ-শকুনের হাতে।’ (মাস্টারদা/পৃষ্ঠা-২১) বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস, বিজয় গাঁথা, ত্যাগ ও নানা রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে অনেক ছড়া এ বইটিতে। একুশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে লেখা হয়েছে অনেকগুলো কালজয়ী ছড়া। বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ ও ভালোবাসার প্রকাশ দেয়া যায় মুজিব নামা, পনেরো আগস্ট ছড়ার মধ্যে। ‘স্বাধীন স্বাধীন স্বপ্নগুলো/খুব সাধারণ খুব সাধারণ/বাংলাদেশের এই জনগণ/কেমন আছে কেমন থাকে/কার কথা কে মাথায় রাখে/কেবল জনগণের জিকির/তার ভেতরে ফন্দি-ফিকির/সহজ কথাও কঠিন লাগে/যায় না বুঝা আগেভাগে/মনটা মজার স্বপ্ন বুনায়/কোন ধুনুনির তুলো ধুনায়/স্বপ্নগুলো তুলো তুলো?’ (স্বাধীন স্বাধীন স্বপ্নগুলো/পৃষ্ঠা-৫৬) স্বাধীনতার জন্য যে ত্যাগ তা থেকে কতোটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছি আমরা? আমাদের পতাকা, আমাদের ভূখÐ, আমাদের জনগণ স্বাধীনতা যাতে হারিয়ে না ফেলে সেদিকে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মনোযোগ রাখতে হবে। আর এই ঐক্যের ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হয় স. ম. শামসুল আলমের ছড়ায়।
স.ম. শামসুল আলম ১৯৬২ সালের ২৫ আগস্ট রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলাধীন শিকজান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম এস. এম. শাহজাহান আলী এবং মাতা সালেহা শাহজাহান। তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে লেখালেখি শুরু করেন এবং একই বছরে ফরিদপুর জেলা পরিষদের মুখপত্র 'মাসিক গণমন'-এ প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হিংসার নক্ষত্র এক'। ১৯৯৪ সালে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই তাঁকে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার কার্যনির্বাহী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই মেলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি লেখালেখিতে সক্রিয় এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, শব্দরম্য, নাটক, কলাম, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। এ পর্যন্ত তাঁর ৪০টির অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা গ্রন্থের সংখ্যা বেশি। স.ম. শামসুল আলম বেশ কিছু সংগঠন থেকে সংবর্ধনা-সম্মাননা পেয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাভীশ দীপঙ্কর গবেষণা পরিষদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সম্মাননা-২০১৪, কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য কবি ওমর আলী সাহিত্য পদক-১৪২২, ছড়াসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্মৃতি পদক-২০১৬, বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি কর্তৃক মায়ের অলংকার গ্রন্থের জন্য কিশোরকবিতা সম্মাননা-২০১৬ প্রভৃতি। বর্তমানে তিনি নির্মাণ ও আবাসন ব্যবসার সাথে জড়িত। শিশু-কিশোর সংগঠন আনন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি দুই সন্তানের জনক- কন্যা শামাদান উফা ও পুত্র আনজাম আনন। স্ত্রী নিগার সুলতানা জুঁই।