কবিতা যে কবির খেয়ালের সাথে বুদ্ধিমত্তার যুথবদ্ধ পথচলা এ উক্তি ১৪০০ বছরের বাংলা কবিতা সম্পর্কে বিজ্ঞ বিশ্লেষকরাই করেছেন। তবে কবিতা সম্পর্কে পণ্ডিতজনেরা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে। বিশ্ব কবিতাকে যেমন নিয়ম-নীতির আদলে নির্ধারিত সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা যায়নি তদ্রæপ বাংলা কবিতাকেও সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। কবিতা সম্পর্কে বোদ্ধাদের বিভিন্ন উক্তি একত্রে মিলিয়ে নিজের মতো করে ভেবে নেওয়ার বিষয়। কারণ কবিতা বাঁক বদলের ধারায় অব্যাহত রয়েছে। চলমান কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে চুলচিড় ধারণা পোষণ করা সমুচিত নয়। তবু কবিতা একটি নিয়ম-নীতির ওপর ভর করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ধারণালব্ধ বিষয় হচ্ছে কবিতা। কবিতা লেখার ধারণা মনের ক্যানভাসে অঙ্কিত করে যে যতটুকু সফলভাবে কবিতা নির্মাণের শৈলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে কল্পনা এবং বাস্তবের সংমিশ্রণ ঘটাতে পেরেছেন সে ততটুকু সফল কবি হিসেবে কালের ইতিহাসে টিকে আছেন এবং থাকবেন। এ সম্পর্কে কবিদের কবি লালন সাঁইজি বললেন, ‘এসব দেখি কানার হাট-বাজার’ আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে নিজেকে নিজে চিনবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানবজাতির উদ্দেশ্যে তার উচ্চারিত বাণী অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। লালন সাঁইজির আত্মোপলব্ধির জ্ঞান থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনানন্দ দাশ বললেন- ‘অন্ধরাই আজকাল বেশি চোখে দেখে কিংবা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।’ এসব কালজয়ী উক্তির পেছনে লুকিয়ে আছে অসম্ভব রকমের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। কবি বলতেই আমরা বুঝি তৃতীয় চক্ষুসম্পন্ন ব্যক্তি। যে ব্যক্তি অন্য পাঁচজন মানুষের চেয়ে আলাদাভাবে একটি বিষয় বস্তুকে দেখবেন। অর্থাৎ কবিরা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকেন। ক্ষুদ্র একটি বিষয়বস্তুকে কবির কল্পনার মনসপটে চিত্রাঙ্কন করে বাস্তবতার সাদৃশ্যে কাব্যিক শব্দের মালা গাঁথার সফল প্রচেষ্টাই কবিতা। এ অর্থে কবি আল মাহমুদ যথার্থই বলেছেন- ‘কবি মাত্রই চিন্তাশীল।’ এই চিন্তাশীলতার মধ্যে সৃষ্টিশীল কিংবা মননশীল বিষয়বস্তু লুকিয়ে থাকলে এবং তা শিল্পগুণে উত্তীর্ণ হওয়ার মতো অনবদ্য ছন্দের পঙ্ক্তিমালাই কবির কাব্যভাবনার সফলতার দ্বার উন্মোচন করে। তবে জীবন চলার পথে প্রতিনিয়ত ঘটন-অঘটনের অভিজ্ঞতা বোধ-বুদ্ধি কাব্যভাবনায় কাজে লাগানোই কবির কাজ। নতুন নতুন শব্দ তৈরিতে যেমন সফলতার পরিচয়ে উদ্ভাসিত হওয়া কবির দায়িত্ব তদ্রæপ নতুন উপমা কিংবা চিত্রকল্পের সাথে বোদ্ধা পাঠক সমাজকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াও কবির দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। ‘বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ শফিক সাইফুল কর্তৃক সম্পাদিত গ্রন্থটি আমার হাতে পৌঁছবার পর হতেই ভাবছিলাম গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছু লেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নানা প্রাসঙ্গিক কারণে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত হওয়ায় লেখাটি লিখতে একটু সময় ক্ষেপণ হয়েছে। ৫৭৬ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি কাব্যচর্চার প্রতি বোদ্ধাদের সংরক্ষণে থাকার মতো গ্রন্থের যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তদ্রæপ বর্তমান সময়ে কবিতার এই সংকলনটি মাইলফলকও বটে। এই ব্যয়বহুল জটিল এবং কঠিন কাজটি সম্পন্ন করার সাথে সাহিত্যদেশ প্রকাশনসহ জড়িত সকলেই নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে শফিক সাইফুলকে দীর্ঘদিন যাবৎ চিনি এবং জানি। সভ্য, ভদ্র, নম্র, বিনয় এবং সদা হাস্যোজ্জ্বলতা তার অঙ্গের ভ‚ষণ- যা আমাকে মুগ্ধ করে। সাংবাদিকতা দিয়ে জীবন শুরু করলেও এখন সে সফল প্রকাশক হিসেবে নিজস্ব আলোতে আলোকিত মানুষ। অনেক লাভজনক পেশা ছেড়ে দিয়ে যখন একজন মানুষ কবি, সাহিত্যিকদের মতো অলাভজনক পেশার মানুষদের সেবক হিসেবে স্বপ্রণোদিত হয়ে নাম লেখান তখন তো তাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। শফিক সাইফুল অনেক শ্রম, ঘাম এবং চিন্তাশক্তির প্রখরতার আলো ব্যয় করে এই গ্রন্থটি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে প্রকাশ করেছেন। শফিক সাইফুলের ‘শিরোনাম লেখা হয়নি’ কবিতাটি গ্রন্থের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। তার গদ্য লেখার হাত খুব ভালো, কিন্তু কবিতা পড়ে থাকলেও অমি আত্মভোলা মানুষ হিসেবে এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। তবে শফিক সাইফুলের কবিতার কয়েকটি চরণ এ রকম- ‘...শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা ঘৃণার দাগ জড়িয়ে এখনো/ গুমরে ওঠে বীরাঙ্গনা/...গণতন্ত্রের আকাশে উড়ছে শকুনির দল/ আইনের চোরাগলিতে আটকে আছে আমার অধিকার/...পেটে ক্ষুধা, কণ্ঠে জরুরি আইনের খড়গ/ আরতো সয় না হে ঈশ্বর/ আকাশটা নিচু করো/ তারাফুল ছিঁড়ে ছিঁডে খাই...। [শিরোনাম লেখা হয়নি] শফিক সাইফুলের উদ্ধৃত পঙ্ক্তিমালাকে অবশ্যই কবিতা বলব। এখানে বর্তমান সময়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। তাই শফিক সাইফুলকে সময় সচেতন কবি বলা যায়। কবিতার সংকলিত গ্রন্থটির কলেবর অনেক বড়। একটি পৃষ্ঠা একজন কবির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি কবির চেহারা পরিচিত করার জন্য ছবি সংযুক্ত করতে গিয়ে ফটোশপ সফওয়্যার তার নিজস্ব খেয়ালে যে বিভ্রাটের ষোলোকলা দেখিয়েছেন তার স্পষ্ট ছাপ গ্রন্থটিতে রয়েছে। কবিতা গ্রন্থ যে সম্পাদনার দাবি রাখে এ বক্তব্য স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথই দিয়েছিলেন। তিনি কবিতার সংকলনের সম্পাদনা করেছেন। তিনি নিজের কবিতার ভুল চিহ্নিত করার জন্য যোগ্য কাউকে দিয়ে সম্পাদনা করানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। নিজের কাছে সহজেই নিজের ভুল ধরা পড়ে না। এ কারণে নিজের কবিতা নিজেই সম্পাদনা করা যায় না, তবে নিজের কবিতা নিজে সম্পাদনা করতে চাইলে তার জন্য কবিতাটির বিষয়, বস্তু, আঙ্গিক, ব্যাকরণ-প্রকরণ মস্তিষ্কের ভাবনা থেকে অবচেতন করতে একটু সময় নিতে হয়। অর্থাৎ নিজের কবিতা নিজে বাক্সবন্দি করে রেখে বেশ কিছুদিন পর বের করে পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করলে নিজের ভুল নিজেই ধরা সম্ভব। এ অর্থে শফিক সাইফুল মৌলিক কবিতার সম্পাদনার গুরুদায়িত্বটি যথার্থই পালন করার চেষ্টা করেছেন। বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার অমর সৃষ্টি বিদ্রোহী কবিতার চরণে চরণে স্তবকে স্তবকে জানান দিয়ে গেছেন, শত নির্যাতন নিপীড়ন, ঝঞ্ঝা, তুফানে, বাধাবিঘেœ কবিদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কবিরা কোনো অন্যায়, অনাচার, অবিচারের সাথে আপস করতে জানে না। শাসকের রক্তচক্ষুতে ভয় করে না কবি। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার মতো যথেষ্ট মনোবল কবিদের রয়েছে। কবিসত্তা অন্যায়ের নিকট মাথা নত করতে জানে না। পরাজয়েও ভয় করে না কবি। পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। কবি যে কখনো কারো কাছে মাথা অবনত করে না সেই চিরসত্য কথাটি ফুটিয়ে তুলেছেন কাজী নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী কবিতায়। কবি তার কাজের জন্য শুধু নিজের বিবেকের নিকট দায়বদ্ধ, এ মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন জাতীয় কবি। সাহিত্য অঙ্গনে সম্পাদনা শিল্পটির যেমন আদর্শিক দিক রয়েছে তদ্রæপ রয়েছে ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যমÐিত কাজটি সম্পাদক অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য অঙ্গনে যেমন বহুল প্রচারিত তথ্য রয়েছে যে, কবিতার আধুনিক রূপের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত দিয়ে। সেখানে গ্রন্থের সম্পাদক শফিক সাইফুল তার সম্পাদনার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন- ‘আবুল হোসেন এর হাত দিয়ে প্রথম বাংলা কবিতা রচিত হয়েছে। এমনকি তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ নব বসন্ত যা ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়, এই কাব্যগ্রন্থটিই প্রথম প্রকাশিত আধুনিক কবিতার গ্রন্থ।’ এই পশ্চাৎপদ সত্য কথাটিকে সাহসিকতার সাথে সামনে তুলে আনার দুঃসাহসিক মনোবল সত্যিই অবাক হওয়ার মতো বিষয়। এ ক্ষেত্রে শফিক সাইফুল সত্যকে সত্য বলার দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে ধন্যবাদ পাওয়ার কাজ করেছেন। ‘বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ গ্রন্থের এই নামকরণে ব্যক্তিক্রমী প্রচেষ্টা বলে মনে হয়েছে। বাংলা কবিতাকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় ভিসা পাসপোর্টের দোহাই দিয়ে কিংবা সীমান্তের কাঁটাতারের ফেলানীর মতো শত শত সহস্র লাশ ঝুলে আছে এই জুজুর ভয় দেখিয়ে স্বতন্ত্র, সাবলীল বাংলাদেশি ভাবধারায় ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস সত্যিই ব্যতিক্রম। পরিশেষে শফিক সাইফুল এবং তার সম্পাদিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ বহুল প্রচারের মাইলফলক হিসেবে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারবে- সেই প্রত্যাশায় থাকলাম। - ড. সৈয়দ রনো, সাংবাদিক, কবি ও গবেষক
শফিক সাইফুল ১ জুন ১৯৮২ সালে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও মাতা মানকিরেন নিসা। ১৯৯৭ সাল থেকে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। সাংবাদিকতা করে লেখার হাত পাকিয়েছেন । সাংবাদিকতার কাজটিও শুরু করেছেন ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি)থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে। তিনি ‘বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করতে গিযে যে অনেক শ্রম, সময় ও মস্তিষ্ক ক্ষয় করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রবীণ থেকে শুরু করে তরুণতম কবি পর্যন্ত স্থান দিয়েছেন নিঃসঙ্কোচে। তারপরও কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে যা ভূমিকাতে অর্থাৎ তাঁর কৈফিয়ত-এ অকপটে স্বীকার করেছেন। দশক বিভাজন করতে কারো নাম হয়ত বাদ পড়েছে, কারো নাম হয়ত পরবর্তী দশকে লেখা হয়েছে। তবুও এত সংখ্যক কবির সমাহার একত্রে উপস্থাপন করার দুঃসাহস একটি অনবদ্য প্রয়াস। গ্রন্থটি কবিমহল-সুধিমহল তো বটেই, সাধারণ পাঠকের কাছেও গ্রহণীয় হবে সন্দেহ নেই। বর্তমানে শফিক সাইফুল প্রকাশনা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। প্রকাশনা সংস্থা ‘সাহিত্যদেশ’-এর কর্ণধার তিনি। সবকিছু মিলিয়ে সাহিত্যকর্ম ছাড়া তাঁর চিন্তা-চেতনায় অন্য কোনো বিষয় রেখাপাত করে না। তাঁর এই মহৎ কর্ম বিস্তৃত হোক অনন্ত পরিধিব্যাপী, সমাদৃত হোক অনন্তকাল।