মঈনুল আহসান সাবেরের কথাসাহিত্য-চর্চা শুরুর সময় শহরবাসীরা ছিল মূলত গ্রাম থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের মানুষ; নাগরিক-মানসে উন্মূলিত গ্রামজীবনের পক্ষপাতী মূল্যবোধ তাই তখনও পর্যন্ত সজীব। কথাসাহিত্যে উন্মূল নগরজীবনের রূপকারদের পদধ্বনিও যে শোনা যাচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু‘ তাঁদের চিত্রিত সে-নগরজীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো-না-কোনোভাবে ছিল গ্রামসুতোয় বাঁধা। তাছাড়া গ্রাম থেকে উন্মূলিত যে অগ্রজ লেখকদের রচনায় গ্রাম প্রধান-উপজীব্য নয় সেখানেও প্রকৃত অর্থে নগর স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কারণ গড়ে-ওঠা পর্যায়ে নগরের অধিবাসীদের মনে নগরচেতনা পারেনি দানা বাঁধতে। নগরচেতনা মানে গ্রামের প্রতি পিছুটানহীন নির্মোহ জীবনানুভূতি। কিন্তু নগরজীবনের নির্মোহতার মধ্যে মানবিকতার যে বিপর্যয় ঘটে চলে তাকে উপলব্ধি করাও নগর-মানসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সঙ্গত কারণেই যাদের জন্ম ও গড়ে-ওঠা গ্রামসূত্রছিন্ন নগরজীবনে তাদের মধ্য থেকে সাবেরের যাত্রাশুরুর কাল পর্যন্ত কথাসাহিত্যের চর্চা তেমন হয়নিই বলা চলে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে একেবারেই নগরজীবন থেকে উঠে-আসা কথাসাহিত্যিক-প্রজন্মের পথিকৃৎ লেখক মঈনুল আহসান সাবের। সমকালের নিরিখে নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের মূর্তরূপ- সব মিলিয়ে এ হতে পারে তাঁর গল্প-উপন্যাস সম্পর্কে সরল অভিধা। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়, তিনি এই জীবনের নিরর্থকতা, গতানুগতিকতা ও অন্তঃসারশূন্যতাকে আবিষ্কার করে তুলে ধরেন পাঠকদের সামনে। তাঁর গদ্যরীতি একদিকে সরল, অন্যদিকে মননশীল- সরল প্রকাশভঙ্গিতে, মননশীল সমাজ-পর্যবেক্ষণে। এর সঙ্গে পাঠকের অনুভবে ধরা পড়ে, ব্যঙ্গের চোরাস্রোত বয়ে চলে তাঁর গদ্যরীতিতে। সমাজের সামগ্রিক মনস্তত্ত্বকে যেমন তিনি বিশ্লেষণ করতে পারেন তেমনি পারেন ব্যক্তির অবক্ষয়িত মধ্যবিত্তীয় মনের স্বপ্ন বিকার ও হতাশাকে তুলে আনতে।
মঈনুল আহসান সাবেরের জন্ম ঢাকায়। ২৬ মে ১৯৫৮। পৈতৃক ভিটে একদা বরিশাল ভাগ হয়ে যাওয়ার পর পিরােজপুর। দেশের বহু বহু জায়গায় যাওয়া হয়েছে, যাওয়া হয়নি ওই পিরােজপুর। বাবার ফেলে আসা ভূমি সাজানাে আছে সাবেরের কল্পনায়। জন্মের পর এই ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। সংসার জীবনও। যদিও এক সময় ইচ্ছা ছিল, থিতু হবেন না, পথে পথে থাকবেন, আজ এখানে তাে কাল ওখানে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তিনিও সেই ওদের মতাে, যাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত না টেনেছে, তার চেয়ে বেশি টেনেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চত্বর। বড়দের জন্য প্রথম লেখা ১৯৭৪-এ। প্রকাশিত হয়েছিলাে সে সময়কার সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। তারপর ৪০ বছর ধরে এই একটিই কাজ, বিরতিসহ বিরতি ছাড়া। প্রথম বই গ্রল্পগ্রন্থ “পরাস্ত সহিস বেরিয়েছিল ১৯৮২ সালে। চাকরি না করে উপায় নেই। তাই করছেন, সাংবাদিকতা। এখন অবশ্য বেকার। বেকার থাকার অভিজ্ঞতা তার আছে। বাসনা বেকারই থেকে যাওয়ার। বেড়াতে ভালােবাসেন। একা থাকতেও পুরস্কার পেয়েছেন সামান্য কয়েকটি। বাপি শাহরিয়ার শিশুসাহিত্য পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার। স্ত্রী নাহিদ নিগার, দু পুত্র আহসান সেনান ও আহসান সাজিদকে নিয়ে তার সংসার।