সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানবিক বোধ, বিশ্বাস, আবহমান গ্রামিণ সংস্কৃতি এই গ্রন্থে উঠে এসেছে সাবলিলভাবে। একটি অভুক্ত কিশোরের লঞ্চঘাটে অপেক্ষার মুহূর্তগুলো উঠে এসেছে ‘আধুলি’ গল্পে। ভাঙন গল্পে এসেছে গৃহহারা মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা, ভিটেমাটিহীন মানুষের অজানার দেশে পাড়ি জমানোর কাহিনি। ‘প্রশান্তির নিঃশ্বাস’ গল্পে এসেছে একজন পোল্ট্রি ফার্মের মালিকের শিয়ালের উৎপাত থেকে ফার্মকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা, হাপিত্যেস, আক্ষেপ ও প্রশান্তির চিত্র। একজন মফস্বল লেখক-সাংবাদিকের সমাজের চলমান অসঙ্গতি, রাষ্ট্রীয় জুলুম, নির্যাতন, বোধের অবক্ষয়ের কথা লিখতে না পারার যন্ত্রণা ও কাতরানির চিত্র ফুটে উঠেছে ‘মহাকালের প্রতিধ্বনি’তে। তিনটি প্রজন্মকে গাঁথা হয়েছে ‘দূর অতীতের কান্না’ গল্পে। পারিবারিক শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অনুভব-অনুভুতি, অনুশোচনার চিত্রায়ণ আছে এ গল্পে। ‘কাছের মানুষ দূরের ভালোবাসা’য় বয়ন করা হয়েছে একজন অর্থপিপাসু মানুষের উঠে আসার কাহিনি। মধ্যবিত্তের ভাঙচুরের ভিতরও শেষ পর্যন্ত প্রেম ও বোধই জয়ী হয়- পরিণতিতে তারই প্রকাশ ঘটে।
‘দূর অতীতের কান্না’ ছোটগল্পের সংকলন। এতে স্থান পেয়েছে মোট ছয়টি গল্প- ‘ভাঙন’(১৯৯৬), ‘মহাকালের প্রতিধ্বনি’(২০০০), ‘দূর অতীতের কান্না’ (২০০২), ‘প্রশান্তির নিঃশ্বাস’(২০০৩), ‘কাছের মানুষ দূরের ভালোবাসা’(২০১২) ও ‘আধুলি’(২০১২)।
ছোট ছোট বাক্যের ভিতর গল্পকার পাঠককে একাকার করে কাহিনির ভিতর ঢুকিয়ে দেন ‘দূর অতীতের কান্না’র প্রতিটি গল্পে। উপমা, চিত্রকল্প, সংলাপের অসাধারণ সমন্বয়ে ‘দূর অতীতের কান্না’ যেন পাঠকের কথাই বলে। গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে তাই পাঠকের কোনো দূরত্ব থাকে না। পাঠকই হয়ে ওঠে গল্পের মানুষ।
লেখক পরিচিতি মনসুর আজিজ গল্প বলেন অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা করে। কবিতায় তার যেমন স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গি রয়েছে গদ্যে ও তেমনি। লেখালেখির শুরু সাতাশিতে হলেও নব্বইয়ের গোড়া থেকেই গল্প লিখছেন। লিখছেন ছড়া, গান, কিশোর কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। অনুবাদ, সম্পাদনা ও সংগঠক হিসেবেও নিরলসভাবে কাজ করছেন তিনি। জন্ম চাঁদপুর জেলার হাইমচরে। বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক মা আনোয়ারা বেগম। হাইমচর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি ও সাভার কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে। ব্যবস্থাপনায় কৃতিত্বের সাথে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমবিএ করেছেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি থেকে। ছোটগল্পে তার ভাষাভঙ্গি, বিষয়, উপস্থাপন টেকনিক অন্যদের মতো নয়। মানুষ ও সমাজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো আশ্চর্যরকম দক্ষতায় তিনি তুলে ধরেন। গল্পেও তার উপমা, চিত্রকল্প ও লোকজ শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়।
মনসুর আজিজের গদ্যশৈলী কাব্যভাষার মতোই অন্যদের চেয়ে পৃথক। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থকে তিনি আলাদা করেছন বিষয়বৈচিত্রে, শৈলীতে। শব্দ বুনে বুনে ইতোমধ্যেই বাংলা কবিতায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তার কবিতা সহজেই ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, আপন করে নেয়া যায়। তাঁর কাব্যগ্রন্থ অতলান্ত নীলচোখ, অনন্ত আকাশের জ্যোতির্ময় নত্র, মনুষ্যত্বের ল্যাম্পপোস্ট, শব্দের বেনারসি, জোড়াপাখি ফুলের রুমাল বাংলা কবিতায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। কবিতা, কিশোরকবিতা, ছড়া ও উপন্যাস মিলিয়ে মনসুর আজিজ এর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তেরোটি। জাতীয় দৈনিক, মাসিক ও সাময়িকীতে নিয়মিত লিখছেন দুই যুগ ধরে।