পূর্বকথা আমার কবিতা- আমার জীবন থেকে উঠে আসা। বাল্যকালে বছর দশেক উপজেলা পর্যায়ে, আর গ্রাম পর্যায়ে দাদার বাড়িতে প্রাইমারি স্কুলে বছর দেড়েক- এই ক’বছরই বলা যায় গ্রামজীবন। তারপর থেকে রাজশাহী সিটিতে অথবা অন্যান্য জেলা সদরে। দাদা-দাদির মৃত্যুর পর দেশের বাড়িতে কেউ না থাকায় (আমার পিতা দাদা-দাদির একমাত্র সন্তান) এবং চাকরি সূত্রে পিতাও আমার শহরবাসী হয়ে যাওয়ায় গ্রামের বাড়ির সাথে যোগসূত্র কমতে থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নেয় প্রচণ্ড স্মৃতিকাতরতা। বাল্যজীবনের স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এই যে শেকড় ছেঁড়া অভিবাসন-তা আমাকে প্রচণ্ড মনোকষ্টে ফেলে দেয়। স্মৃতি সবারই থাকে কিন্তু কবিরাই সম্ভবত সর্বাধিক স্মৃতিকাতর। অবশ্য কোনটা স্মৃতি নয়? অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, পঠন-পাঠন- সবই তো স্মৃতি সম্পৃক্ত।
ফলে আমার কবিতা একই সঙ্গে নাগরিক ও গ্রামীণবোধ সম্পন্ন। স্মৃতিতাড়িত হয়ে প্রায়ই মোটরবাইকে দেশের বাড়ি (গ্রাম : ভাতুড়িয়া, থানা : মোহনপুর, জেলা : রাজশাহী) চলে যাই। পুরাতন পরিত্যক্ত মাটির সড়কগুলো খুঁজে বের করে সে সব রাস্তায় ভ্রমণ করতে থাকি। এভাবে আমি বাংলার প্রকৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ি। বাস্তবে সেটা বরেন্দ্রভূমির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে লেখা হয় দীর্ঘ কবিতা ‘উৎস ভূমি’। এটি অনেকের কাছেই প্রশংসিত হয়। ১ম কাব্য ‘মগ্ন প্রতীক; লেখা হয় চাকরি জীবনের ১০ম বছরে- বেশ বয়সকালে। আসলে আমি বুড়ো ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে নেমেছিলাম। ছোটবেলায় সপ্তম শ্রেণিতে কবিতা/গল্প দিয়ে শুরু হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কবি বন্ধুরা আমার কবিতার চেয়ে গল্প ভালো হচ্ছে- বলে গল্প নিয়েই থাকতে পরামর্শ দেয়। গল্পে কিছুটা পরিচিতিও আসে। তারপর চাকরিজীবনে সবকিছু থেকেই বিচ্যুতি। শেষে ক’জন তরুণ কবি- আমার চেয়ে বয়সে ৭/৮ বছর ছোট, তাদের উৎসাহে সহযোগিতায় কবিতা পড়া লেখা চলতে থাকে। তারা আমাকে বইটই সরবরাহ করে। বিদেশি কবিতার অনুবাদ পড়ি প্রচুর। বাংলা কবিতার আদ্যপান্ত পড়ি, বই সংগ্রহ করি এবং লিখতেও চেষ্টা করি। নতুন ও কনিষ্ঠ কবি বন্ধুরা আমার কবিতা ভালো হচ্ছে বলে জানায়। এখন বুঝতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা হয়নি- কারণ পড়ার ঘাটতি ছিল। সে জন্য সঠিক সঙ্গ, কবিদের সাথে নিয়মিত আড্ডা- ইত্যাদি খুব জরুরী কবিদের জন্য্ ১ম কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন প্রতীক’- এ গ্রিক মিথ- এর বেশ প্রয়োগ ছিল। পরবর্তী ‘রূপান্তরের পাখি’, ‘মিশ্রমানব’-এ দেশজ মিথ-এর ব্যবহার লক্ষণীয়। এছাড়া শারীরিকভাবে সে সময় কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ি। ফলে মৃত্যুচিন্তা আসে কবিতায়। বোধকরি সে কারণেই প্রত্ননিদর্শন, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক স্থান, ভবন ইত্যাদির ওপর এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়্ সে সবই কবিতায় আসতে থাকে। ‘মিশ্রমানব’ কাব্যে এর নির্দশন আছে। চাকুরী সূত্রে চলনবিলের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রায় এক দশক ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়। চলন বিল পাড়ি দিয়েছি প্রায় ২০/২২ বার। ঐ এলাকার নদী খাল বিলেও ঘুরেছি প্রচুর, যার ফলে ‘ওই নদী জলমঞ্চ’ নামে একটি কাব্যেরই জন্ম হলো যা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘অনিঃশেষ ধারাপাত’, ‘শূন্যতার ডানা’ এই বই দু’টি বরেন্দ্রভূমির নানা দৃশ্যকল্পে পরিপূর্ণ।
এর ফাঁকে ফাঁকে পরিবার- বাবা-মা, স্ত্রী পুত্র কন্যা, দাদা দাদি সকলকে নিয়েই ক্রমাগত লিখেছি। দেশের নানা অস্থির সময়-বিশেষত ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশের নানা অস্থিরতা- এসব ধরা আছে ‘শূন্যতার ডানা’ ও ‘অদৃশ্য পুরোহিত’-এ। জলপাখিদের প্রত্নগভীরতায় প্রকৃতি বিশেষত বরেন্দ্রভূমির প্রকৃতি আছে, সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ওপর কবিতা আছ্ েনগর জীবনের নানা হতাশা, যন্ত্রযুগের যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই বুঝি প্রকৃতির ভেতরে ঢুকেছিলাম। হাওয়াদের রাজারাণীতে ভ্রমণ আছে, প্রত্নতত্ত্ব আছে, বাড়ি ছেড়ে দূরের জেলায় চাকরির অভিজ্ঞতা এসব ছাপ ফেলেছে। পরিবার ছেড়ে দূরে দীর্ঘ এক যুগ চাকরি করায় আমার লেখার পরিমান বেশি। একাকীত্ব ও নির্জনতা লেখার জন্য সহায়ক।
পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছে ‘শিশ্নতন্ত্র’, যেখানে খোলামেলা যৌনতাও আছে। এখঅনে আমার জীবন দর্শন কিছুটা ফুটে উঠেছে। বোদলেয়ার বলতেন- দর্শনই সব। আমারও তাই ধারণা। আপাতত শেষ কাব্য ‘বসন্তের কুশীলবগণ’- এর অনেকগুলো কবিতাই বসন্ত ঋতুনিয়ে লেখা। ২০১২ সালেরবসন্ত কালে টানা ২০/২১ দিন ধরে প্রতিদিন লেখা হয়েছে- একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। শরীর-স্বাস্থ্য ও যৌনতার সাথে সৃজনশীলতার কোনো সম্পর্ক আছে বোধকরি। এ বছর বসন্তে ঐ দু’টি বিষয়েই অবস্থা ভাল যাচ্ছিল আমার। ফলে, একটা উদ্মাদনার মধ্যে টানা ২০/২১টি কবিতা লেকা হয়েছিল। শুধু বসন্ত বা প্রকৃতিই নয়, সেই সাথে দর্শন যুক্ত হয়েছে সেখানে। কবিতা বা শিল্পই শুধু নয়- সত্যের সন্ধানকেও আমি জরুরি মনে করি। পুরনো অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা, গোঁড়ামি ও নীতিকেন্দ্রিক পশ্চাৎপদ মূল্যবোধ পাল্টাবে। এক্ষেত্রে লেখাকেও একটা বূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করি। এই কাব্য অভিযাত্রার পেছনে হতাশা, অবক্ষয়, অসুস্থতা, বিচ্ছিন্নতা, দেশ, রাষ্ট্র, অফিস ও পরিবারের নানা অশান্তি-অপ্রাপ্তির যত অনুভূতি- সে সবই আমাকে ক্রমে কবিতার রাজ্যে ঠেলে দিয়েছে।
সমগ্র যখন হচ্ছে তখন কয়েকটি কবিতার পুনর্লিখন করেছি, ক্রুটি-বিচ্যুতি কিছু সংশোধন করেছি। এখন থেকে এই সমগ্রকেই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করতে হবে।