ফ্ল্যাপে লিখা কথা একদিন দু’দিন নয়, মাজহারুল ইসলাম দিনের পর দিন কাটিয়েছেন কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। খেয়ালি , আবেগপ্রবণ ,প্রতিভাবান হুমায়ূন আহমেদের একনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তিনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রিয় মানুষ প্রিয় লেখককে ঘিরে ছিলেন।
মহান এই লেখকের প্রয়াণে মাজহারুল ইসলাম কোনো শোকোগাথা লিখেন না। বরং জীবনের দুর্লভতম নয়টি দিন-রাত্রির কথা লিখেছেন তাঁর এই গ্রন্থে। দুর্লভ এই কা্রণে যে, জীবনের ২১৬ টি ঘন্টা ইউরোপের তিনটি দেশ একত্রে ঘুরেছেন তাঁরা দু’জন।
হুমায়ূন আহমেদ যখনই দেশে কিংবা দেশের বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছেন ,দলবল ছিল তাঁর সঙ্গী। এ-ই ছিল তাঁর রীতি। সেই তিনি শুধু মাজহারুল ইসলামকে সাথি করে নয়টি দিন-রাত্রি পার করেছেন জার্মানি, ফ্রান্স আর ইতালিতে। ইউরোপের ঐতিহ্য আর রূপের এই ঝলকের ভিড়েও মাজহারুলের একমাত্র আকর্ষণ ছিল প্রিয় লেখককে একান্তে দেখা, অনুভব করা ।এই বইয়ে সেইসব অনুভব আর ঘটনার বর্ণনা আছে, যার দুর্লভ ও চাক্ষুষ সাক্ষী তিনি।
হুমায়ূন ভক্তরা প্রিয় লেখকের অন্য আরেক চেহারা খুঁজে পাবেন এই বইয়ে।
ভূমিকা হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে এক মহীরুহ । এক যুগেরও বেশি সময় এই মহীরুহের সুশীতল ছায়ায় কেটেছে আমার অহর্নিশি । লেখক সত্তার বাইরে একজন ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে আমি প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করেছি নতুন নতুন পরিচয়ে।
এক অদ্ভুত সম্মোহনে জড়িয়েছেন তিনি আমায়। তাঁর মতো একজন কিংবদন্তি লেখক এবং অনন্যসাধারথণ মানবিক গুনাবলির ব্যক্তিকে নিয়ে কিছু লেখার কথা আমার দূরতম ভাবনাতেও কখনো ছিল না।আমি লেখক নই, সামান্য একজন সম্পাদক-প্রকাশক। মুগ্ধ বিস্ময়ে একজন মহান লেখকের যাপিত জীবন খুব কাছে থেকে দেখেছি আমি, প্রায়শই জড়িয়ে গিয়েছি তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে -আমার মতো অভাজনের জন্যে এর চেয়ে আনন্দ ও অহংকারের অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে!
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আনন্দময় স্মৃতিগুলো একান্তই আমার । বহুবার নানা স্মৃতি মনে করে আপ্লুত হয়েছি, বোঝার চেষ্টা করেছি মানুষটিকে। ভেবেছি, তিনি তো আছেনই নয়ন সমুখে, স্মৃতি গুলো জমা থাক নিউরন।কী দরকার ওগুলো দিয়ে শব্দের মালা গাঁথার! কিন্তু হায়, আজ ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’।
নয়ন সমুখ থেকে সর তিনি যখন ঠাঁই নিয়েছেন নয়নেরই মাঝে, তখন মনে হলো প্রকৃতির নিয়মে একসময় নিউরনের কোষগুলো ক্ষয়ে যেতে শুরু করবে, ঝাপসা হয়ে আসবে কিছু স্মৃতি। তাই সুখস্মৃতিগুলোর কিছুটা হলেও দি অক্ষরবন্দি করতে পারি তবে তা আমার বিষণ্ন সময়ে আনন্দের উপলক্ষ হতে পারে। এই আনন্দ আমি জীবনভর উপলব্ধিতে রাখতে চাই।
নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার চিকিৎসার প্রায় পুরোটা সময় তাঁর স্ত্রী আর দুই পুত্রের সঙ্গে আমিও সেখানে ছিলাম পরিবারের একজন হয়ে। যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি গ্রহন আর এরই মাঝে লেখালেখি, অ্যাটিকে বসে ছবি আঁকা, দুই শিশুপুত্রের খুনসুটি, স্ত্রীর মায়াময় সঙ্গ, বাইরে ঘুরতে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া এভাবেই কেটেছে দিনগুলি তাঁর। প্রায় সন্ধ্যাতেই দাবা খেলতেন তিনি আমার সঙ্গে। কত স্মৃতি! কিন্তু লিখতে সবলে ভারী হয়ে ওঠে মনটা , কলম থেমে যায়। দুঃস্বপ্নের মতো সামনে এসে দাঁড়ায় ১২ জুন ২০১২ থেকে ১৯ জুন ২০১২ এর ঘটনাবলী। তিনি তখন হাসপাতালে , লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। প্রথম দফা অপারেশনের পর ১৯ জুন বাসায় ফিরেছিলেন । কী যে খুশি হয়েছিলাম আমরা! মাত্র দুদিন পর একরাশ হতাশা আমাদের পেছনে ছেয়ে ফেলল। এবং ক্রমশ তা নিয়ে গেল গহীন অন্ধকারে।
এই মুহূর্তে তাঁর নিউইয়র্কের দিনগুলি নিয়ে কিছু লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। লিখতে চেষ্টা করেছি বহুবার, এগুতে পারি নি। চোখ ভিজে উঠেছে জলে, হাত নিঃসাড় হয়ে এসেছে। তবে আমি লিখব এ নিয়ে , আরও কিছুটা সময় পরে।
আমার এই রচনা, ভ্রমণকাহিনী বা স্মৃতিকথা যে নামই অভিহিত করি না কেন, এ থেকে পাঠক বিশেষ কিছু পাবেন-এমন প্রত্যাশা আমি করি না। তবে আমি চেয়েছি নয় দিনের একটি ভ্রমণকে উপলক্ষ করে ব্যক্তি হুমায়ূনের একটি শব্দচিত্র আঁকতে । কতটুকু পেরেছি জানি না। লেখকসত্তার বাইরের মানষটি কেমন ছিলেন সেই ছবি যদি খানিকটাও আঁকতে পারি তবে তা হবে আমার জন্যে বাড়তি পাওয়া। মাজহারুল ইসলাম দক্ষিণ হাওয়া, ধানমন্ডি ,ঢাকা
স্কুলজীবন থেকে সম্পৃক্ত নানা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় যুক্ত হন গ্র“প থিয়েটার আন্দোলনে। এসময় তিনি মুদ্রণ ও প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গেও জড়িত হন অপেশাদার হিসেবে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৯৬-এর জানুয়ারিতে পাক্ষিক ‘অন্যদিন’ সম্পাদনা ও প্রকাশনার মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন যাত্রা। পরের বছর সৃজনশীল প্রকাশনায় উৎকর্ষের সন্ধানে শুরু করেন ‘অন্যপ্রকাশ’। বই প্রকাশে পেশাদারিত্ব আর মুদ্রণ ও বিপণনের আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে অল্প সময়েই তা মনোযোগ আকর্ষণ করে সবার। বাংলা ভাষার সবচেয়ে জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সকল বই এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রকাশের ফলে একটা অভিনব জুটি তৈরি হয়, লেখক-প্রকাশক জুটি। দুই দশক ধরে লেখালেখি করছেন। তাঁর মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা ৬টি। এরমধ্যে রয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার গল্প’ ও ‘রুম নম্বর বত্রিশ’, ভ্রমণগ্রন্থ ‘হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে নয় রাত’, ‘সিকি শতাব্দী আগে : বজ্র ড্রাগনের দেশে’ ও ‘গ্যাংটকে গ্যাঁড়াকল দার্জিলিংয়ে কোলাহল’ এবং স্মৃতিকথা ‘হুমায়ূন আহমেদের মাকড়সাভীতি ও অন্যান্য’। সম্পাদিত গ্রন্থ ‘আনিসুজ্জামান : দীপ্র মনীষা’ এবং ‘সৈয়দ শামসুল হকের কলমের সঙ্গে সংসার’সহ সম্পাদনা গ্রন্থ নয়টি। ছোটপর্দায়ও রয়েছে শিল্পিত পদচারণা। তাঁর পরিচালনায় নির্মিত পাঁচটি টিভি নাটক, একটি টেলিফিল্ম ও একটি ৫৫ পর্বের ধারাবাহিক নাটক দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে। তিনি বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি, এশিয়া প্যাসিফিক পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির ঢাকা মহানগর কমিটির বর্তমান সভাপতি। তিনি সিটি ব্যাংক আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের প্রথম আলো সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। স্ত্রী তানজিনা রহমান স্বর্ণা ও দুই পুত্র অমিয় মাজহার-অন্বয় মাজহারকে নিয়ে তাঁর আপনভুবন।