ফ্ল্যাপে লিখা কথা ভিক্টর হুগো (১৮০২-১৮৮৫) বিশ্ব সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা।ভিক্টর হুগোর সাহিত্যকর্মের অন্য দিক হচ্ছে বলিষ্ট প্রাণময়তা এর নাটকীয় ঘটনাবলীর কুশলী সংস্থাপন ও পরিবেশন। পাঠককে তাঁর কাহিনী অনায়াসে সাবলীলতায় , প্রায় রুদ্ধশ্বাস ঔ সুকো, সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ভিক্টর হুগো সৃষ্টি চরিত্রগুলো তাঁদের দুর্জয় সাহস, অসংঙ্কোচের চরম ঝুঁকি নেবার প্রবণতা প্রত্যুপন্নমতিত্ব ও প্রবল প্রাণশক্তির জন্য বিশ্বসাহিত্যের পাঠককুলের অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, সর্বকালে, সর্বদেশে। লেখার প্রাচুর্যের দিক থেকেও যে ভিক্টর হুগো সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখদের অন্যতম তাই নয়, মৌলিকত্ব এবং প্রাণবন্ততার দিক থেকেও তিনি অসামান্য।
কিন্তু ভিক্টর হুগোর আসল পরিচয় কুশলী ঔপন্যাসিক হিসেবে। তাঁর কাহিনী আমাদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সহজেই টেনে নিয়ে যায় । তাঁর উপন্যাসের পাত্রপাত্রী আমাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। আমরা তাদের সঙ্গে একাত্নতা অনূভব করি।
জুলফিকার নিউটনের অনুবাদ সাবলীল উপভোগ্য, উচ্চ প্রশংসার দাবিদার। অনুবাদগুলো ভাবানুবাদ নয় তবে আক্ষরিক অনুবাদও নয়। কোথাও কোথাও তিনি একটু বদলে নিয়েছেন, সামান্য সম্প্রসারিত করেছেন। কোথাও কোথাও , কিন্তু কখনোই মূল সুরকে বিকৃত বা ব্যাহত হতে দেননি। বাংলা ছন্দের ব্যাপক ঐতিহ্য এবং বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে তিনি তাঁর অনুবাদে নিপুন ভাবে ব্যবহার করেছেন। কিছু কিছু শব্দ প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে এটাও বোঝা যায় যে অনুবাদক সচেতন ভাবে তার অনুবাদ সম্পর্কে আমাদেরকে নিজস্ব সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে একাত্ন করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তবে এ জাতীয় কয়েকটি প্রয়োগের অপরিহার্যতা বা উৎকর্ষ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে জুলফিকার নিউটনের ভাষা বেগবান ,বিষয়ের সঙ্গে সুসামঞ্জস্য, বক্তব্য, পটভূমি,চরিত্র ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে ছন্দে ও শব্দের বৈচিত্র্য তিনি এনেছেন তা বিশেষ প্রশংসনীয়।
ভিক্টর মারি হুগো ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০২ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহন করেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিশাল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার সন্তান ছিলেন তিনি। একাধারে সাহিত্য এবং রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ফ্রান্সে সা¤্রাজ্য আইন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তিত হওয়া এবং সেই প্রক্রিয়ার নানান উত্থান-পতনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্যারিসে বসবাসরত ভিক্টর হুগো তরুণ বয়সেই তার কবিতা, কল্পকাহিনি এবং নাটকের জন্য বিখ্যাত এবং কখনো কুখ্যাতও হয়েছিলেন। ১৮৪৫ সালে, তার বিখ্যাত গ্রন্থ লা মিজারেবল লেখার সময়, রাজা তাকে ফ্রান্সের উচ্চকক্ষের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। আইনসভার সর্বোচ্চ দলের সঙ্গে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। তিনি সেখানে সবার জন্য বিনা খরচে লেখাপড়া, সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের বিলুপ্তির ব্যাপারে কাজ করা শুরু করেন। ১৮৪৮ সালে যখন রাজ্যে উন্নতির জোয়ার স্পষ্টভাবে কড়া নাড়ছিল, তিনি লা মিজারেবল লেখা বন্ধ করে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ১৮৫১ সালে যখন দেশের প্রেসিডেন্ট নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন, হুগোর রাজনৈতিক চেতনার বিরোধিরা তাকে বৃটিশ চ্যানেলের একটি দ্বীপে নির্বাসনে বাধ্য করে। নির্বাসনে থেকেই ১৮৬০ সালে তিনি আবার লা মিজারেবল লেখার কাজে হাত দেন এবং পরের বছর উপন্যাসটি শেষ করেন। ১৮৭০ সালে সম্রাটের পতন হলে হুগো ফ্রান্সে ফেরত আসেন, যেখানে তাকে গণতন্ত্রের মানসপূত্র হিসেবে বিপুলভাবে সম্মানিত করা হয়। ২২ মে ১৮৮৫ সালে ভিক্টর হুগোর মৃত্যুর পরে ফ্রান্সের রাস্তায় তার কফিন বয়ে নেবার সময়ে বিশ লাখ মানুষের ঢল নামে। সেদিন ফ্রান্সের জনগণ যতভাবে সম্মান জানানো সম্ভব, জানিয়ে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।