ভূমিকা একাত্তর সালের কোন সমন্বিত চিত্র আমাদের নেই। ব্যক্তি/পরিবার/গোষ্ঠীর চেতনায় যে বিচ্ছিন্ন চিত্রাবলি আছে তার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা হয়নি। যার জন্যে যুদ্ধ কখনো 'সেই সময়' কারো কাছে 'গণ্ডগোল' কারো ভাষায় 'অমানিশার কালো রাত' ইত্যাদি। চিত্রগুলো নেতিবাচক। যুদ্ধ শেষে একজন নেতা বলেছিলেন, ছেলেদের নয় মাস নষ্ট হয়েছে। যুদ্ধশেষে আমরা মৃত্যুর বেদনা বহন করেছি বুক ভরে, পাকিস্তানিদের অনাচার অত্যাচারের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছি গল্প কবিতায় অথবা স্মৃতি কথায়। লিপিবদ্ধ করেছি বন্দিত্বের দিন যাপন। কবি শামসুর রাহমান যাকে বলেছেন নরক যাপন। নগরবাসী কবি, আমার জানামতে, যুদ্ধের সময় প্রায় প্রতিদিন স্বাধীনতাকে আবাহন করে, স্বাধীনতার সৈনিকদের স্বাগত জানিয়ে অবিস্মরণীয় কবিতা লিখেছেন। এই কবির সাহচর্য পেয়েছে অবরুদ্ধ ঢাকায় অবস্থানরত প্রত্যক্ষ যোদ্ধারা। স্মৃতিতে তিনি গ্রামের সবুজ প্রান্তরে গলা উঁচিয়ে গাওয়া কিশোরের বেসুরো গানটিতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন: 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...' কিন্তু তার স্মৃতিতে ভারী বুটের সশব্দ ভয়াবহতার পাশে গেরিলার নিঃশব্দ পদসঞ্চার স্থান পায়নি। নগর কি ছিল শুধু কারাগার, হায়নার হুঙ্কার? রাতের আঁধারে নিঃসাড় চরণে কারা এগিয়ে গেল-কণ্ঠ রোধ করল হায়নার?
শহীদ জননী হিসেবে অধিক পরিচিত জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য নাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও তার বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়ক হিসেবে বাংলাদেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মাঝে তিনি অন্যতম। জাহানারা ইমামের জন্ম অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায়, ১৯২৯ সালের ৩ মে। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম হলেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলী তাকে পড়ালেখা করান। পরবর্তীতে পুরকৌশলী স্বামী শরীফ ইমামও তাঁর পড়ালেখায় উৎসাহ যোগান। ১৯৪৫ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন। চাকরিজীবন শুরু করেন বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্কলার এই কৃতি নারী ষাটের দশকের ঢাকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মহলে তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য ছিলেন সুপরিচিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। অসম্ভব মেধাবী রুমী তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেছে নিলে তিনি তাকে অনুপ্রেরণা যোগান ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোপনে সাহায্য করে চলেন যোদ্ধাদের। যুদ্ধে রুমী ধরা পড়লেও তাঁর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ও তাঁর স্বামী ক্ষমা চাইতে রাজি হননি ঘাতকদের কাছে। তিনি এই যুদ্ধ চলাকালে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত দিনলিপি, যা পরবর্তীতে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামে প্রকাশিত হয় এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত জাহানারা ইমাম এর বই সমগ্র পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে, এর একটি বড় কারণ হলো তাঁর রচনার হৃদয়গ্রাহীতা ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে গড়ে তোলেন ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ, তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় সমর্থনে গড়ে তোলেন গণ আদালত। জাহানারা ইমাম এর বই সমূহ হলো ‘অন্য জীবন’, ‘গজকচ্ছপ (শিশুতোষ)’, ‘সাতটি তারার ঝিকিমিকি (শিশুতোষ)’, ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’, ‘প্রবাসের দিনলিপি’ ইত্যাদি। মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মিশিগানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।