ভূমিকা নিশাপুর কা শাহীন শুরু করার আগে ইতিহাসের সে পাতাগুলো উল্টানোর ইচ্ছা করেছিলাম যাতে বিংশ শতাব্দীর এক চেঙ্গিস খানের কাহিনী দৃষ্টিগোচর হয়। আর সে চেঙ্গিস খান মুসলমানদের জাতীয় আদর্শের সুন্দরতম ভিতের ইজ্জত রক্ষাকারী কতগুলো দেশ- সমরকন্দ, বোখারা সফানিয়ান, তাশকন্দ এবং আরও অন্যান্য বেশ কিছু শহর স্বীয় করতলগত করে একক হুকুমাত কায়েম করেছিলেন। কিন্তু কিছু অস্বীকৃত ঘটনার ভিত্তিতে এ বিষয়ের কলম ধরতে হিম্মত করছিলাম না। যার মধ্যে ঐতিহাসিক প্রমাণপত্রাদির দুষ্প্রাপ্যতা অন্যতম। তবুও গুজরাটের সাপ্তাহিক আল হাদীদ সম্পাদক জনাব মাসউদুর রহমান আমাকে বরাবর উৎসাহিত করায় ব্রত ছিলেন। আমি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছি না। যাই হোক, আমি তার সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলাম যে অবশ্যই একদিন না একদিন আমি আমু দরিয়া ও সিহু দরিয়ার এ ক্ষুদ্র মৎসের ওপর দু’কলম লেখার শক্তি প্রযোগ করব।
‘সলীব ও হেরম’ পুস্তিকাটি লেখা শেষ করে আরি কোন নতুন বিষয়ের উপর কলম ধরতে দোদুল্যমান অবস্থায় সময় ক্ষেপন করছিলাম। কখনও এ বিষয়ে কলম ধরব বলে চিন্তা-ভাবনা করতাম কিন্তু হিম্মত হতো না। অবশেষে মত পরিবর্তন করলাম এবং মাহমুদ গজনবীর শাসনাবসানের পর দীর্ঘ সময় হিন্দুস্তানের ওপর যে দুঃসময় অতিবাহিত হয়েছে তা জানার অভিযানে ব্যাপৃত হলাম। যতই এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলাম ততই আমার মনের আগ্রহ বাড়তে লাগল। ফলে অধিকাংশ রাতেই সারসূতী নদীর তীরে তরাইনের যুদ্ধের ভয়াবহতার দৃশ্য স্বপ্নলোকে দৃশ্যমান হত। কিন্তু চোখ খুললেই দেখতাম নিজ কক্ষের দৃশ্য। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কিছু কিতাব ছাড়া কলম হাতে নেয়া সম্ভব নয়। সে সময়টা মুসলমানদের জন্য এমন এক দুঃসময় ছিল যে, তারা হিন্দুদের সর্বনিম্ন জাতি শূদ্র থেকেও মানবেতর জীবন যাপন করত। তারা রাখালবিহীন উট-বকরির পালের মত যেখানে সেখানে নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করত। না ছিল মুসলিম অধিপতি, না ছিল মুসলিম সেনাপতি। আর না শোনাত কেউ মান-সম্মান রক্ষার অভয় বাণী। মহরওয়ালা থেকে নিয়ে নগরকোট এবং বাঠণ্ডা থেকে বেনারস পর্যন্ত হিন্দু রাজা পাথুরা এবং খাণ্ডে রায় রক্তপিপাসু হায়েনার মত মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো অতর্কিত হামলার নায়ক হয়ে। আর লেলিহান কুকুরের মত পৈশাচিক থাবায় মুসলিম জিন্দেগী নরকাগ্নির অতল গহ্বরে তলিয়ে দিচ্ছিল। না ছিল কোন মুসলমানের ইজ্জতের নিরাপত্তা; না ছিল জাতীয় তাহজিব-তমদ্দুনের স্বাধীনতা। এ অবস্থায় নরপিশাচ হিন্দুরা চিত্তবিনোদন প্রকাশার্থে স্বীয় প্রতিমার পদপ্রান্তে মুসলিম মানবকে বলিদান করে আপন দেবতাকে খুশি করত। এটা ছিল তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস।
ঠিক সেই মুহূর্তে কুদরতী অনুভূতি জাগ্রত হল এবং গজনীর সেই প্রাচীন কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটল। ভারতবর্ষকে প্রকম্পিত করে এক মহান ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল। যিনি কাবুল থেকে সোমনাথ পর্যন্ত এবং সিস্তান থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত যাবতীয় হিন্দু প্রতিমা ভেঙ্গে চুরমার করে ওদের হৃদয়ে প্রকম্পন ধরিয়ে দেয়। হিন্দুস্তানের এ দুরাবস্থা কাটিয়ে সুব্যবস্থাপনায় ঢেলে সাজাতে কুদরত যাকে নির্বাচিত করে দেন তিনি হলেন শেহাবুদ্দীন ঘুরী। আর তিনিই প্রথম মুসলিম নৃপতি যার নসীবে ভাগ্যবিধাতা এ হিন্দুস্তানে মজবুত সুসজ্জিত হুকুমত কায়েম করার দায়িত্ব লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। এমন মজবুত মুসলমান একালে দু’চার জন আছে কিনা ভাবতে কষ্ট হয়। আজ মুসলিম জাতি বর্ণ, বংশ, দেশ বিভাগ, ভাষার বৈষম্য নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এতে মুসলিম ভূখণ্ডগুলো এক সংকীর্ণতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। মুসলমানদের এ সংকীর্ণতার সুযোগে পাশ্চাত্য লাল কুকুরগুলো ঠাণ্ডা মাথায় আফগানী সাধারণ মুসলমানদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। চতুর্দিকে অত্যাচারের লেলিহান অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। নিরাশা ও ধ্বংসের অমানিশা গোটা মুসলিম ভাগ্যকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর সে লাল কুত্তারা আমাদেরই সামনে আমাদেরই দুর্ভাগ্য রচনা করছে।
আফগান স্বাধীনতাকামীরা আর কতকাল অন্ধকার পর্বতগাত্রে লুকিয়ে লুকিয়ে জীবনবাজির ইতিহাস লিখতে থাকবে? আর কতকাল চেঙ্গিস খানের উত্তরসুরীরা মুসলিম বিশ্ব ধ্বংসের মাতাল খেলায় মত্ত থাকবে? আর কত কাল মুসলিম জযবার উত্তাল তরঙ্গ চুপসে বসে থাকবে। কতকাল এ দুর্দান্ত শির উঁচু জাতি মাথা নিচু করে বসে থাকবে? এ জাতীয় হাজার প্রশ্ন তুলে ধরা হবে এ ঘুমন্ত জাতির কাছে। কিন্তু ইসলামী জগতের কাছে এর কোন জবাব নেই।
সুধী পাঠক! আমরা ইসলামের ডুবন্ত সূর্যের ক্ষীণ আভা দেখতে পাচ্ছি। তবুও আমরা যেন আমাদের ঈমানী অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু নয়ন-যুগল খুলে সব কিছু অবলোকন করছি। আর মজলুম বিশ্বের আর্তচিৎকার শুধু কান পেতে শুনছি। তবুও যেন আমরা অনুভূতিহারা হয়ে সবকিছু না জানার, না শোনার ভান করে নিজেকে হারিয়ে এক অজানা জগতে আত্মগোপন করে আছি। তবে জীবনের এ রঙিন চাদরমুড়ি দিয়ে আর বেশি দিন লুকিয়ে থাকা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, তোমরা শাহী বাজ হয়েও কেন হীন পেচার জীবন যাপন করছ? তোমরা তো ছিলে সিংহ শার্দুল; কেন অসহায় মৃগয়ার ভূমিকা পালন করছ? এ সকল প্রশ্নের সদ্ত্তুর দিতে না পেরে আমাদের বলতে হবেÑ আমরা ছিলাম অসহায়, গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আমার মাথার খুলি দিয়ে পাশ্চাত্য লাল কুত্তারা ফুলদানী আর পান পাত্র তৈরি করত। জানি না সে কে? সে কোথায়? যিনি এ জাতির দোদুল্যমান তরণীর কাণ্ডারী হবে। তবে আমার বিশ্বাস, সে দিন বেশি দূরে নয়; যখন কেউ না কেউ আমাদের ভাগ্যরক্ষক, জাতির কাণ্ডারী হয়ে এ ডুবুডুবু তরণীর হাল ধরবে। বসন্তের কোকিল সুদিনের সুজন অনেকই পাওয়া যায়; জানি না অদূর ভবিষ্যতে এ মুসলিম মিল্লাতের কঠোর দুর্গ রক্ষক কে হবে?