ভূমিকা রণদা প্রসাদ সাহা , আর পি সাহা নামেই যিনি সমধিক পরিচিতি, অশেষ কৃতিমান ব্যক্তিত্ব। সংগ্রাম করে তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং জীবনের অর্জিত সম্পদ অকাতরে প্রদান করেছিলেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে। প্রথম মহাযুদ্ধকালে বাঙালি পল্টনের সদস্য হিসেবে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি বিশেষ পদকে ভূষিত হয়েছিলেন, সেই সঙ্গে তাঁর কীর্তি হয়ে উঠেছিল বাঙালির শৌর্য ও বীরত্বের প্রতীক। পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে বিত্তের চাইতেও বড় ছিল তাঁর চিত্তের প্রসারতা। তিনি তাঁর সমুদয় ধন-সম্পদ জনকল্যাণে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কেবল দান নয়, বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে যেন সামাজিক কল্যাণে নিবেদিত সংস্থাগুলোর ব্যয় নির্বাহ হতে পারে এমন এক কার্যকর ব্যবস্থা তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন। দূরদর্শী ও সচেতন মানুষ হিসেবে তিনি স্বোপার্জিত অর্থে স্থাপন করেন নারীশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতিষ্ঠান এবং সেসবের সুষ্ঠু পরিচালনা ও বিকাশে আর্থিক সহায়তা জোগাতে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে স্থাপন করেন কল্যাণ ট্রাস্ট। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হোম্স্ কেবল বাংলাদেশের নয়, উপমহাদেশের দুই অনন্য প্রতিষ্ঠান।কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের আয় দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো আজো কার্যকর অবদান রেখে চলছে সার্থকতার সঙ্গে। বাস্তববুদ্ধি, দূরদর্শিতা ও মানবকল্যাণ-চেতনার অনন্য সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে । এই মহানুভব মানুষটিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে । তাঁর সঙ্গে শহীদ হন পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা এবং প্রতিষ্ঠানের আরো তিন কর্মী।
আর পি সাহার কাছে জাতির অশেষ ঋণ। বাঙালি জাতির বহুমুখী সাধনার প্রতীক অনন্য পুরুষ। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কল্যাণধপারায় উপকৃত মানুষের মধ্যে ধর্মবর্ণ শ্রেণির কোনো বিভাজন ছিল না, মানবহিতৈষণার অনন্য উদাহারণ তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে। পূর্ণ মানব হিসেবে নারী সত্তার বিকাশে ধারণা তিনি অন্তরে পোষণ করেছেন এবং এর বাস্তবায়নের পথে পথ তৈরি করে গেছেন । তাঁর প্রয়ানের পর অতিক্রান্ত হয়েছে চার দশগেকরও বেশি সময়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা ও তিন কর্মীসহ অপহৃত হন আর পি সাহা, তারপর থেকে তাঁদের আর খোঁজ মেলেনি। অবধারিত মৃত্যুপথে তাঁদের ঠেলে দেয়া হলেও পরিবার-পরিজন, বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের প্রতীক্ষা তো আর ফুরোয় না। সে কারণে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগও অনেককাল ছিল স্থগিত। আর তাই দীর্ঘ বিলম্বের পরে তাঁর প্রতি জাতির ঋণ পরিশোধের তাগিদ থেকে বর্তমান স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষ যেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছেন তা আর পি সাহার প্রতি তাদের অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই সঙ্গে সহায়তা বহন করে। এই গ্রন্থ প্রকাশে রাজীব প্রসাদ সাহা এবং কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সহযোগিতা আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি।
মহৎ বাঙালি রণদা প্রসাদ সাহার প্রতি জাতির শ্রদ্ধা নিবেদনের এমনি অকিঞ্চিৎকর প্রয়াস যদি তাঁর জীবন ও অবদানের সঙ্গে সকলের, বিশেষভাবে নবীন প্রজন্মের, পরিচয় নিবিড় করতে কোনো ভূমিকা পা্লন করে তবে গ্রন্থ প্রকাশের আয়োজন সার্থক বিবেচিত হবে। সম্পদনা পরিষদ
আনিসুজ্জামান একাধারে একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ভাষা সংগ্রামী, সংবিধানের অনুবাদক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক। এককথায় তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। এই গুণীজন ১৯৩৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুল থেকে। কৈশোরে পরিবারসমেত বাংলাদেশে চলে আসলে খুলনা শহরের এক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন আনিসুজ্জামান। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতক জীবনে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মুনীর চৌধুরীর মতো কিংবদন্তি শিক্ষকদের, যাদের সান্নিধ্যে তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি বেশ কিছু বৃত্তি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন এবং 'কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো' হিসেবে লন্ডন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি শিল্প ও সাহিত্যকলার বিভিন্ন শাখায় জড়িত আছেন। আনিসুজ্জামান এর বই সমগ্রতে তার প্রখর চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচয় মেলে। আনিসুজ্জামানের বইগুলো বেশিরভাগই গবেষণা এবং প্রবন্ধধর্মী। আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধ এবং গবেষণা গ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘আমার একাত্তর’, ’সোশ্যাল এস্পেক্টস অব এন্ডোজেনাস ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি’ ইত্যাদি। আনিসুজ্জামান এর বই সমূহ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'সাহিত্যে ও সমাজে', 'কালচার এন্ড থট', 'নারীর কথা', 'আইন-শব্দকোষ' ইত্যাদি। তিনি অসংখ্য পদক-পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেছেন। সেসবের মধ্যে ১৯৭০ সালে প্রবন্ধ-গবেষণার জন্য ‘বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ১৯৮৫ সালে শিক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২০০৫ সালে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডি.লিট’ ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১৪ সালে তিনি ভারত সরকার প্রদত্ত 'পদ্মভূষণ' পদক লাভ করেন।