১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ খোলার মাধ্যমে আধুনিক যুগের যাত্রা শুরু হয়। গদ্য সাহিত্য আধুনিক যুগে যাত্রা শুরু করে। সুতরাং সেই হিসেবে উপন্যাসের যাত্রা আধুনিক যুগেই। ‘ইতিহাস বিচারে যাকে আধুনিক কাল বলা হয় সে- কালের সাহিত্যকর্মের প্রধান এবং শক্তিশালী শাখা হলো উপন্যাস- একথা সমালোচকদের দৌলতে আমাদের জ্ঞাত।` এর মাধ্যমেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা না বলা কথাগুলোকে শিল্পীত দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছি। উপন্যাস বা কথাসাহিত্য এমন একটি আধুনিক সাহিত্য রূপ, যার উদ্দেশ্য জীবনের সমগ্রতার সন্ধান করা। সমাজ ও মানুষের ব্যক্ত-অব্যক্ত জীবনের সামগ্রিক রূপায়ণ সম্ভব এখানে। ঔপন্যাসিকের দায়িত্ব থাকে মানুষের বহির্লোক-অন্তর্লোকের পূর্ণাঙ্গ চালচিত্রের অনুসন্ধান করার। কেননা কথাসাহিত্যের প্রধান দাবিই যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে জীবনকে বিচার করে তার মূলসুরকে ধারণ করা । ব্যক্তি মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানসিক সংকট ও জীবন বাস্তবতার মূলীভূত সত্তার অন্বেষণ আধুনিক কথাসাহিত্যের বিষয় হিসেবে পরিগণিত। বাংলা উপন্যাসে এর প্রাথমিক স্ফুরণ লক্ষ করা যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) উপন্যাসে । উপন্যাস এমন একটি শিল্পমাধ্যম যেখানে আমাদের জীবনের সমগ্রতাকে ধারণ করা হয়। তবে অবশ্যই শিল্পীত স্বরগ্রামে। এ বিষয়ে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘উপন্যাস হচ্ছে আধুনিকতম এবং সমগ্রতাস্পর্শী সেই শিল্প-প্রতিমা, যেখানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় জীবনের আদি-অন্ত; শিল্পীত স্বরগ্রামে উদ্ভাসিত হয় লেখকের জীবনার্থ আর তাঁর স্বদেশ-সমাজ-সমকাল । আর যিনি ঔপন্যাসিক তাঁর মানসভূমি নির্মিত হয় তাঁর দেশ, কাল ও সমাজের প্রেক্ষিতে। উনিশ শতকের নবজাগরণের ঢেউ বাংলাকে নানাভাবে পল্লবিত করেছিল। এ থেকে বঙ্কিমচন্দ্রও মুক্ত ছিলেন না। তাই তাঁর সৃষ্টিকর্মে এসবের শিল্পীত রূপ ধরা পড়েছে। ঔপন্যাসিকের মানসোৎকর্ষের প্রতিফলন ঘটে তাঁর শিল্পকর্মে । শিল্পীর স্বাধীন জীবন- জিজ্ঞাসার নিজস্ব নিয়মে সে মানসোৎকর্ষের ক্রমবিকাশ ঘটলেও দেশকালীন চিন্তাসূত্রগুলিকে অনুধাবন না করলে সে মানোসোৎকর্ষের সঠিক ঠিকানা মেলে না । ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেহেতু প্রথম আমাদের মনোলোক বিশ্বের চলিষ্ণু জীবনধারার সঙ্গে লগ্ন হবার সুযোগ লাভ করল, সেহেতু বঙ্কিমের দেশকালীন ভাব ও ভাবনার রূপ পরিচয়ে প্রায় বিশ্বপরিচয়ের আনন্দই লভ্য। সে বিচারে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের নতুন কালের ভাব-স্পন্দন অনেক গভীরভাবে অনুভূত হলেও সেকালের ইংল্যাণ্ডীয় শিক্ষার প্রকৃত পরিণাম কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্ৰ ।
Bankim Chandra Chattapadhyaya- জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৬ জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের পূর্বে তাঁর আরও দুই পুত্র জন্মান – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যান নি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তাঁর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হন নি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” ১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন; তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁটালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁটালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাঁকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তাঁর পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল। কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু। তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত। শেষ জীবনে তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)