বহুমুখী প্রতিভা নামক অভিধাটি সংযোজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন সমাজে দুর্লভ না হলেও আমাদের হাজার বছরের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে এ যুগের মাইকেল-রবীন্দ্রনাথের পর নজরুলের বেলাতেও প্রয়োগ করা যায়। সমগ্র বাঙালি দেশ-কাল-সমাজ- সংস্কৃতিকে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাঁর মতো আর কেউ বোধ করি আলোড়িত- উজ্জীবিত করতে পারেননি। নজরুল মূলত কবি হিসেবে জনচিত্তে শ্রদ্ধার আসন পেলেও তিনি একাধারে ছিলেন গীতিকার, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক, পত্রিকা-সম্পাদক প্রভৃতি। কবি ও গীতিকার হিসেবে তিনি আমাদের কাছে আজও সমুদ্রতুল্য। সুবিশাল রবীন্দ্রসাহিত্য-সংস্কৃতি সাধনা দীর্ঘকাল পরিসরে পরিব্যাপ্ত; কিন্তু নজরুল-সাধনা মাত্র তেইশ বছরেই সমাপ্ত। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ধনাঢ্য-পরিবারে, বিত্ত-বৈভব-আভিজাত্য তাঁর সঙ্গী সারাজীবন; নজরুলের জন্ম দরিদ্র পরিবারে, দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী চিরকাল। রবীন্দ্রনাথ সুস্থ, সৌম্য, শান্ত ও প্রাজ্ঞতার প্রতীক, নজরুল অশান্ত, অস্থির, ঘরছাড়া, অগোছালো, বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্থ। ধূমকেতুর মতো উদয়-বিলয় তাঁর। মাত্র তেইশ বছরের সাহিত্য-জীবন, তারপরেও বেঁচেছিলেন কবি অনেক দিন; জীবনমৃত সৃষ্টিহীন বাঁচা- নীরব-নিস্তব্ধতায়-দুরপনেয় অসুস্থতায়। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকাল দীর্ঘ, নজরুলের তুলনামূলকভাবে হ্রস্ব।