আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে মাত্র এক দশকের কাব্য-সাধনায় যিনি সম্পূর্ণযাত্রার নির্দিষ্টতা নিশ্চিত করেছিলেন, তিনি কবি আবুল হাসান। সৃষ্টি বীজমন্ত্রে আবুল হাসান তাঁর অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আপন আলোয়, নতুন দিনের সুর ব্যঞ্জনায়। আত্মগত দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, স্মৃতিমুগ্ধতা, নিঃসঙ্গভাবনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর কবিতার মূল সুর। সেসবের আলেখ্য এবং অন্তর্গত রূপ তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। সার্থকভাবে প্রতিফলিত করেছেন পাঠকের কবিতাপ্রীতির আয়নায়।
একজন কবি হিসেবে আমরা যাকে কবিসুলভ ব্যক্তিত্ব বলে উল্লেখ করে থাকি আবুল হাসান ছিলেন তাই। কবিতার প্রতি পুরোপুরি সমর্পিত। নিজের কবিতা সম্পর্কে দারুণ উদ্বেলিত থাকতেন সবসময়। কোনো কবিতা সম্পর্কেই তিনি নিঃসংশয় ছিলেন না, কখনোই বলেননি-ভালো হয়েছে এবং সে কারণেই হয়তো তিনি নিরন্তর কবিতা লিখে যেতে পেরেছেন। এমন কি রোগসজ্জায়, ভ্রমণে অথবা ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময়েও তাঁর কণ্ঠে কবিতার কথা ঘুরেফিরে এসেছে। কবিতাই ছিল তাঁর একমাত্র আরাধ্য বিষয়। নারী, প্রেম, প্রকৃতি, দুঃখ, যন্ত্রণা, দাহ, কোনো কিছুই নয়, আবার সবকিছুই তাঁর কবিতার, একমাত্র কবিতার উপাদান হয়ে উঠেছে... আবুল হাসান-এর কবিতা তরুণ-প্রাণের নিরন্তর সঙ্গী, পাঠকদের সে কারণে আন্দোলিত করবে সবসময়... তরুণ কবি ও গবেষক আহমেদ ফিরোজ-এর সুসম্পাদনা ও কবিতা নির্বাচন এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কবিতার সঙ্গে কবির সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি-এ-গ্রন্থকে গবেষক ও কবিতাপ্রিয় পাঠকের কাছে আরো দরকারি করে তুলেছে।
আবুল হাসান ১৯৪৭ সালের ২৭ আগস্ট গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ার বর্নি গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস পিরােজপুর জেলার নাজিরপুরের ঝনঝনিয়া গ্রামে। তিনি ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি এবং ১৯৬৫ সালে। বরিশালের ব্রজমােহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেও মধ্যপথে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশােনার ইতি ঘটান। ১৯৬৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে যােগদানের মাধ্যমে শুরু হয় তার কর্মজীবন । পরবর্তীকালে দৈনিক গণবাংলা (১৯৭২-১৯৭৩), দৈনিক জনপদ (১৯৭৩-৭৪) পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আবুল হাসানের প্রকাশিত গ্রন্থ : রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২), যে তুমি হরণ করাে (১৯৭৪), পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা' (১৯৮৫), কাব্যনাট্য ‘ওরা কয়েকজন (১৯৮৮), আবুল হাসানের গল্প (১৯৯০)। জীবদ্দশায় আবুল হাসান উল্লেখযােগ্য কোনাে পুরস্কার পাননি। মরণােত্তর পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৫), একুশে পদক (১৯৮২)। আবুল হাসান ১৯৭৪ সালের ১৯ নভেম্বর জার্মানির বার্লিন যান চিকিৎসার জন্য, ফিরে আসেন ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর মাত্র আটাশ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।