রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশ্ব-কথাটি সর্বদাই যুক্ত থাকে। কী অর্থে এই কথাটি প্রযোজ্য ভেবে দেখা উচিত। যাঁরা জ্ঞানী পাঠক তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন কাব্যের কোন্ উপকরণ দেশ ও কালের অতীত, কোন্ পদ্ধতি সার্বভৌমিক, কোন্ লিখন-ভঙ্গি অমর। সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন করে, তার উপাদানের ও উপাদান-সংযোগের চিরন্তন মূল্য যাচাই করা সাধারণ পাঠকের শক্তিতে কুলায় না। সকলেই কিন্তু একটা কথা বোঝেন, কবি হতে গেলেই দেশ ও কালের ভেতরে থেকেও তাদেরকে অতিক্রম করতে হয়, কবির কাছে তাঁর দেশ ও কাল উপায় মাত্র। এমন অনেক কবি আছেন যাঁদের কাব্যবস্তু ও কাব্যাবস্থান আমাদের সুপরিচিত না হলেও তাঁরা আমাদের নিতান্ত প্রিয়। তাঁদের পরিমণ্ডল সম্বন্ধে আমাদের আপেক্ষিক অজ্ঞানতা আমাদের রস-গ্রহণের মাত্রা হ্রাস করে মনে হয় না। কিন্তু অন্য একটা দিক থেকে আমাদের কাছে দেশ ও কালের একটা বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে অন্তত দেখার আনন্দ হয়, যাকে চিনি না তার কাছে সংকোচ বোধ করি, তাকে আপন করতে সময় লাগে, অভ্যস্তকে আমরা সহজে গ্রহণ করি, অনভ্যস্তকে আমরা ভয় করি, নচেৎ অনিচ্ছায় গ্রহণ করি। আমাদের কাছে আমাদের দেশ ও কাল বন্ধুর মতনই পরিচিত।
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯০৯ সালে বারাসাত স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯১২ সালে রিপন কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও অর্থনীতিতে এমএ (১৯১৮, ১৯২০) ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২২-৫৪) ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৪-৫৯) অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৪৫ সালে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে উন্নীত হন এবং ১৯৪৯ সালে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাঝে তিনি উত্তর প্রদেশ সরকারের প্রচার বিভাগের উপদেষ্টা (১৯৩৮-৪০) এবং লেবার এনকোয়ারি কমিটির সদস্য (১৯৪৭) নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে তিনি মস্কোয় অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। একই বছর তিনি হেগ শহরে সোশ্যাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউটে সমাজতত্ত্বের অতিথি অধ্যাপক হয়ে ‘সোসিওলজি অব কালচার’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন (১৯৫৩-৫৪)। ১৯৫৫ সালে তিনি বান্দুং সম্মেলনে যোগ দেন এবং ১৯৫৭ সালে ইন্ডিয়ান সোসিওলোজি কনফারেন্সের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি দেশ-বিদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় বহু মননশীল প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সবুজপত্র ও পরিচয় পত্রিকার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ধূর্জটিপ্রসাদ বাংলা গদ্যরীতিতে প্রমথ চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। তাঁর মুখ্য পরিচয় একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে। অন্তঃশীলা (১৯৩৫), আবর্ত (১৯৩৭) ও মোহানা (১৯৪৩) তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস। এতে সমকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে নর-নারীর প্রেম ও আত্মজিজ্ঞাসার কথা আছে। ত্রিধারা তাঁর অপর উপন্যাস। গদ্যগ্রন্থের মধ্যে আমরা ও তাঁহারা (১৯৩১), চিন্তয়সি (১৯৩৪), সুর ও সঙ্গতি (১৯৩৭), কথা ও সুর (১৯৩৮), মনে এলো, ঝিলিমিলি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রধান কয়েকটি ইংরেজি রচনা হলো: Basic Concepts of Sociology, Modern Indian Culture (১৯৩০), Personality and Social Sciences (১৯৩৪), Tagore- A study (১৯৪০), On Indian History (১৯৪৪), Views and Counterviews, Diversities, Indian Music ইত্যাদি। অবসর জীবনে ধূর্জটিপ্রসাদ দেরাদুনে অবস্থান করেন (১৯৫৫-৬১), কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬১ সালের ৫ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। [শিপ্রা দস্তিদার]