"আত্নপরিচয়" বইয়ের ভূমিকা: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মপরিচয়’-নামক এই গ্রন্থটি একই শিরােনামে রবীন্দ্রনাথের ছয়টি প্রবন্ধের সমষ্টিরূপে ১৯৪৪ সালে পুলিনবিহারী সেন কর্তৃক সংকলিত ও বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থের সংকলিত ভাষ্য নয়। বিশ্বভারতীর ২৯ খণ্ডে প্রকাশিত পুরাতন সংস্করণ রবীন্দ্র-রচনাবলীর সপ্তবিংশ খণ্ডের, তথা ১৮ খণ্ডে প্রকাশিত নতুন সংস্করণ রবীন্দ্র-রচনাবলীর চতুর্দশ খণ্ডের, পাঁচটি প্রবন্ধ সংবলিত ‘আত্মপরিচয়’-নামক গ্রন্থটির সঙ্গে রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রথম খণ্ডের ‘অবতরণিকা' আর পুরাতন অষ্টাদশ খণ্ডের, তথা নতুন নবম খণ্ডের, ‘পরিচয়'-শীর্ষক গ্রন্থের ‘আত্মপরিচয়’-নামক রচনাটির সমন্বয়ে গঠিত বর্তমান গ্রন্থটি মােট সাতটি প্রবন্ধের একটি সম্পাদিত ভাষ্য। রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয়ের এই পরম্পরাটা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে বলেই প্রবন্ধগুলির উপস্থাপনে এ-গ্রন্থে অনুসৃত পুনর্বিন্যাসটি আমার শ্রেয় বােধ হয়েছে। সেদিক থেকে দেখলেও, এটা আসলে পুরাতন আধারে নূতন আধেয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই সংস্করণে আরও একটি নতুনত্ব আছে। সেটা হল, প্রবন্ধগুলির রচনাকালীন প্রথম পরিকল্পিত কিংবা ব্যবহৃত অথবা মুদ্রিত শিরােনামগুলি দিয়ে একটি সচিপত্র জুড়ে দেয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মপরিচয়’-নামক এই গ্রন্থটিতে। এতে প্রবন্ধের বইটিকে একটু বেশি প্রাণবন্ত বােধ হবে। কেননা রবীন্দ্র-রচনাবলীর ‘আত্মপরিচয়'-নামক গ্রন্থটিতে শুধু সংখ্যা সংবলিত শিরােনামহীন প্রবন্ধগুলিকে, একঘেয়ে বা অবন্ধুজনােচিত না-হলেও, বড়াে বেশি নৈর্ব্যক্তিক অবশ্যই মনে হয়— যেখানে গ্রন্থটির “আত্মপরিচয়”-শিরােনাম আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্তিক।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।